গল্প দুঃখের গল্প

কেউ কথা রাখে না – Keu Katha Rakhe Na by Rupan Nath

“আমাকে ছেড়ে কোনোদিন চলে যাবি না তো?” কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল পূজা, তার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ উজাড় করে।

“না রে পাগলি, তোকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? তুই যে আমার প্রাণ! তোকে ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবো না,” রাহুল স্নেহে তার চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিল।

দুই বছরের প্রেমময় পথচলা। পূজাই ছিল রাহুলের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম অনুপ্রেরণা। অথচ, রাহুলের অতীত ছিল ঠিক তার বিপরীত। আগে সে ছিল এক অবিবেচক, বহুনারীসঙ্গী, আবেগহীন পুরুষ। তার জীবনে ভালোবাসা মানে ছিল কেবল বিনোদন, সম্পর্কের মধ্যে কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। কিন্তু পূজার সংস্পর্শে সে বদলাতে শুরু করেছিল। তার মন যেন ধীরে ধীরে কোমল হতে থাকলো।

একদিন ডাকপিয়ন এলো রাহুলের নামে এক সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র নিয়ে। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, তবে চাকরির স্থল বাড়ি থেকে বহু দূরে। পরিবার-পরিজন, পূজাকে বিদায় জানিয়ে, রাহুল পাড়ি দিলো নতুন জীবনে।

প্রথম প্রথম নিয়মিত ফোন, বিরতিহীন মেসেজ। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে ওঠার পর পূজাকে ফোন না করলে যেন দিনটাই সম্পূর্ণ হতো না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব যেন অনুভূতিতেও জায়গা করে নিলো। চাকরির ব্যস্ততা, নতুন পরিবেশ, নতুন সহকর্মী… সব মিলিয়ে পূজার সঙ্গে যোগাযোগের ফাঁক বাড়তে থাকলো।

ফেসবুকের ইনবক্সে এল এক অচেনা নাম – তৃপ্তি অধিকারী। প্রথমে উপেক্ষা, তারপর আলাপচারিতা, তারপর প্রতিদিনের অভ্যাস। তৃপ্তি রূপে মুগ্ধকর, জ্ঞানে উজ্জ্বল, ব্যক্তিত্বে দুর্দান্ত। তার সঙ্গে কথা বললেই যেন একটা নতুন জগতের দরজা খুলে যেত।

ধীরে ধীরে পূজার সঙ্গে কথা বলা কমে এলো। পূজার ফোনকল রাহুল ধরতো অনীহায়, দায়সারা গোছের উত্তরে এড়িয়ে যেতো। পূজার সন্দেহ বাড়তে থাকলো, তাদের সম্পর্কের গভীরতা যেন ফাঁপা হতে থাকলো। প্রেমের সেই উষ্ণতা কোথাও যেন হারিয়ে গেল।

তৃপ্তি ছিল রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। আইটি সেক্টরে চাকরি করতো, আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিদীপ্ত। তৃপ্তির তুলনায় পূজা যেন ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছিল রাহুলের মনে। সে তুলনা করতে থাকলো, বিচার করতে থাকলো, আর পূজা প্রতিবারই যেন হেরে যাচ্ছিলো।

এক বছর পর, রাহুল একেবারে নীরব হয়ে গেলো। ফোন আর ধরে না, বার্তা পাঠালেও উত্তর নেই। পূজা আজও অপেক্ষায় থাকতো, মনে পড়তো তাদের একসময়ের ভালোবাসামাখা কথা। পূজা একদিন অন্য নম্বর থেকে ফোন করলো। ওপাশ থেকে এল সেই কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠস্বর – “হ্যালো?”

এক মুহূর্তের জন্য পূজার পৃথিবী থমকে গেলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে গেলো সেই স্বপ্ন।

“তুই আর ফোন করিস না, আমি বিবাহিত। বছর দুই হলো আমার বিয়ে হয়েছে, আমার একটা কন্যাসন্তানও আছে। তুই ফোন করলে আমার প্রবলেম হবে। ভালো থাকিস। বাই।”

পূজার কণ্ঠে কোনো শব্দ আসেনি। গলা শুকিয়ে এসেছিলো, সমস্ত কথাগুলো দলা পাকিয়ে গেলো মনের গহীনে। সে বুঝলো, প্রতিশ্রুতিগুলো কেবল বাতাসে ভেসে থাকা মিথ্যে শব্দ ছিলো।

এরপর পূজা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো, এক অন্ধকারে। সমাজ তাকে তাড়িয়ে দিলো, পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। বাড়ির অশান্তি, সামাজিক কলঙ্ক থেকে পালিয়ে গেল সে।

আজ দশ বছর কেটে গেছে। রাহুলের বাড়িতে মাঝে মাঝে যাই, তার বৃদ্ধ বাবার পাশে বসে থাকি। কোনো কথা বলেন না তিনি, শুধু দরজার দিকে চেয়ে থাকেন, হয়তো ছেলের অপেক্ষায়। তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যুর আগে ছেলের একটিবার মুখ দেখার আকাঙ্ক্ষা ছিলো, কিন্তু পূরণ হয়নি। মৃত্যুর আগে শেষ কথাটি ছিল, “আমার ছেলে কি আসবে?”

বহুবার রাহুলকে ফোন করেছি, বাবার অসুস্থতার কথা জানিয়েছি। প্রতিবার একটাই উত্তর – “Please check the number you have dialed.”

কেউ কথা রাখে না।

সবাই কথা দেয়, সবাই আশ্বাস দেয়। কিন্তু কথা…কেউ রাখে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *