ভানগড়ের ভৌতিক ঘটনার কথা নিশ্চয় অনেকে শুনেছেন। ভানগড় দূর্গ, যা রাজস্থানের রাজগড়ে অবস্থান করছে। বলা হয়, ভানগড় দূর্গে নাকি আজও ভয়ংকর ভৌতিক ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া যায়। এই বিষয় নিয়ে অনেকের অনেক রকম মত বর্তমান। কেউ এটিকে বিশ্বাস করে, কেউ বা আবার এটিকে অস্বীকার করে। কেউ বা আবার সুযোগ পেলে তা প্রত্যক্ষ করারও ইচ্ছাপ্রকাশ করে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যারা প্রত্যক্ষ দর্শনের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন, তারা যদি তা প্রত্যক্ষ দর্শণ করার সৌভাগ্যলাভ করে, তারা আবার আমাদের সমাজে ফিরে আসেন না, যদি ফিরে আসেন, তো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন না। তাই এই বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকে।
এই রকমই একটি ঘটনা ঘটে রাজীব বাবুর সাথে। রাজীব বাবু, আমাদের পাশের পাড়ার গন্যমান্য ব্যক্তি, যিনি পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি কোনোদিনই ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করতেন না। তাই বহুবার তার মুখ থেকে প্রকাশ পেয়েছে, সুযোগ পেলে ভূতের দর্শণ করবেন। তিনি ভূত প্রেত নিয়ে মজাই করতেন।
রাজীব বাবু প্রতিদিন সন্ধ্যায় মগড়ার চা’য়ের দোকানে গল্পগুজব করতে আসেন। সেখানে শুধু রাজীব বাবুই নন, আসতেন, বাদল বাবু, পেশায় উকিল, জীবন দা, অলোকেশ, সুশীল, আরো অনেকেই। প্রত্যেকেই চাকুরীজীবি এবং বেশ গণ্যমান্য। আর আমি গোপাল, ছোটো খাটো কোম্পানী চাকরি করি। কিন্তু তাই বলে, আমার পেশা নিয়ে, উনারা কখনো আমার সাথে খারাপ আচরণ করেননি বা কখনো আচরণে বুঝিয়ে দেননি যে, তাদের তুলনায় আমি কিছুই নই। মগড়ার চায়ের দোকানটাই একমাত্র স্থান, যেখানে আমরা সন্ধ্যের পর, সাক্ষাৎ করি এবং আমাদের গল্প গুজব চলতে থাকে, প্রায় রাত ন’টা সাড়ে ন’টা অবধি। যতক্ষণ না মগড়ার দোকান বন্ধ হয়। মাঝে মাঝে তো চায়ের দোকানের ঝাপ ফেলতেই দেরী করে ফেলে দোকানের মালিক ছেনা দা।
বছর খানেক আগের কথা, রাজীব বাবু, সন্ধ্যের চায়ের দোকানে গল্প করতে করতে বলেছিলেন, “বুঝলে বাদল! আমি এবার ভূতের দর্শণ করতে যাচ্ছি।”
মজার ছলে, বাদল বাবুও বললেন, “কেন হে? কোথায় চললে?”
- “এই তো পরশু ভানগড় যাচ্ছি।”
কথাটি শুনে কেউ গুরুত্ব দিলে, কেউ বা দিলে না। কারণ, অধিকাংশ লোকই জানেন না, ভানগর আসলে কি? এরপর যখন ভানগড় রহস্যের বিষয়ে উন্মোচন করা হলো, তখন প্রত্যেকেই রাজীব বাবুকে বারণ করার চেষ্টা করলেন। কি দরকার! এত অ্যাডভেঞ্চার করার?
সেদিনের মতো আলোচনা গল্প গুজব সমাপ্ত হওয়ার পর, আমরা প্রত্যেকেই বাড়ি ফিরে আসি। রাজীব বাবুও সময় মতো বেড়িয়ে পড়লেন ভানগড়ের উদ্দেশ্যে।
রাজীব বাবু সেই যে ভানগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন, সেই থেকে উনাকে আর দেখতে পাইনি। শুনেছি, উনার স্ত্রী ও সন্তানেরা থানায় ডায়ারি করে এসেছেন। কিন্তু কোনো খোঁজ না পাওয়ায়, পুলিশও কেশ ক্লোজ করে দিয়েছে।
ধীরে ধীরে প্রত্যেকের দৈনন্দিক কাজে ব্যস্ত থাকার দরুণ, রাজীব বাবুর স্মৃতি ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। আমরা যখন প্রত্যেকেই বুঝে নিয়েছি, রাজীব বাবু বোধ হয়, আর পৃথিবীতেই নেই। ঠিক তখনই ঘটলো এক বিস্ময়কর ঘটনা!
গত শুক্রবার, এক অদ্ভুত ধরনের ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো আমাদের পাড়ায়। চোখ মুখ চুল ও দারিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। ওই ব্যক্তির মুখ স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। তবে তার কথা শুনে যা মনে হলো, তিনি হলেন, রাজীব বাবুর বন্ধু। তিনিও পেশায় শিক্ষক। তবে, তিনি এখন আর নেই। তার বিষয়ে বিষদ কিছু জানতে পারিনি। তবে তার অগোছালো কথায় যেটুকু বুঝলাম, তার বিষয়বস্তু হলো অনেকটা এইরকম এবং সেটিকে তাঁর মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করছি –
“রাজীবের খুব ইচ্ছে ছিলো, জীবনে একবার হলেও ভানগড় দর্শন তিনি করবেন। শুধু দর্শনই করবেন না, সেখানে এক রাত কাটাবেনও। হঠাৎ তিনি আমাদের বললেন, ভানগর গেলে কেমন হয়। আমি প্রথমে অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু প্রণব, অমিত, শুকতান, ভাস্কর, এমন জোড়াজোড়ি শুরু করলো যে, আমি আর না করতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে আমিও রাজীবের কথা স্বীকার করলাম এবং আমরা ভানগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে, দু-তিনদিন এখানে ওখানে ঘোরাফেরা করার পর, আমরা জয়পুর থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে ভানগড় ফোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তবে আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে রাতে থাকার কথা বললে, আমাদের সে বারংবার সাবধান করে, কিন্তু আমরা পরোয়া করিনি।
যথারীতি আমাদের পরিকল্পনামাফিক ভানগড় পোর্টে পৌঁছালাম। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সমস্ত ভানগড় পোর্ট নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার আবছা আলো ধীরে ধীরে আমাদের চারপাশে ঘনিয়ে আসছিল।
আমরা সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, মনে হচ্ছিল কেউ আমাদের অনুসরণ করছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, পায়ের নিচে শুকনো পাতার মর্মর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি বিকট শব্দে আমরা চমকে উঠলাম।
আমরা সবাই একে অপরের দিকে তাকালাম, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশ থেকে এক অজানা অনুভূতি ঘিরে ধরল। চারপাশের বাতাস শীতল হয়ে উঠল, আর তখনই… পেছন থেকে একটা কাঁপানো আওয়াজ শুনতে পেলাম! আমরা আতঙ্কে জমে গেলাম।
তারপর… হঠাৎ রাজীব যেন অন্য কেউ হয়ে গেল! তার চোখদুটি অস্বাভাবিক লাল, মুখ বিকৃত, গলায় এক অদ্ভুত কণ্ঠ! সে গর্জন করে উঠলো, “ওরা আমায় নিয়েছে! আমায় ছেড়ে দাও!” তারপর সে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমরা আর পালাতে পারবে না!”
আমরা আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়লাম! রাজীবের শরীর থরথর করে কাঁপছিল, সে যেন আর স্বাভাবিক মানুষ নেই! হঠাৎ সে এক লাফে বাতাসে উঠে গেল! আমরা চিৎকার করতে করতে দৌড়ালাম, কিন্তু পেছনে শুনতে পেলাম বিকট হাসির আওয়াজ! তারপর…
রাজীব বাবুকে যখন পাওয়া গেল, তার শরীর স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু চোখদুটি ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা! যেন সে আর আমাদের রাজীব নেই! এখন প্রশ্ন, এই রাজীব কি সত্যিই ফিরে এসেছে? নাকি তার শরীরে অন্য কেউ বাস করছে…