অন্যান্য গল্প গল্প

চিন্তার এক জীবন

চিন্তার এক জীবন
রুপন নাথ

মানবজীবন বড়ই রহস্যময়! সুখ খোঁজার আশায় পথ চলি, অথচ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই চিন্তার ভারে নুয়ে পড়ি। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি, চিন্তা যেন অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী! ‘চিন্তা’—এই তিন অক্ষরের ভারী বোঝা কখনো কাঁধে, কখনো মনে, কখনো চোখের পাতায় জমে থাকা নিরব অশ্রুবিন্দু হয়ে বয়ে চলে।

শৈশবের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তার প্রথম পদধ্বনি—পড়তে হবে, মানুষ হতে হবে! কচি হৃদয়ে তখনো বুঝতে শেখেনি, এই ‘মানুষ হওয়া’ আসলে কত কঠিন! স্কুলে ভর্তি হলেই আরেক চিন্তার আগমন—ভালো নম্বর চাই, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। খেলার মাঠের মুক্ত হাওয়া ছেড়ে চার দেয়ালে বন্দি হয়ে বইয়ের পাহাড় টপকাতে হয়। রাত জেগে বইয়ের পাতায় চোখ রাখলে চোখের নিচে কালি জমে, অথচ চিন্তার রঙ আর ম্লান হয় না।

তারপর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক! পরীক্ষার প্রশ্নের চেয়ে বড়ো প্রশ্ন—‘কি হবে? কি হবে?’ চিন্তার ভারে ঘুম হারাম। উত্তরপত্রে কালি পড়ার আগেই, চিন্তার ছায়ায় স্বপ্ন মলিন হয়ে যায়। কলেজ পেরোতেই মনে হয়, এবার বুঝি মুক্তি! অথচ এই তো চিন্তার নতুন মোড়—কী করবো এরপর? চাকরি? নাকি ব্যবসা? রোজগার না হলে জীবন চলবে কি করে?

আর মেয়েদের জীবনে? চিন্তার স্বর কিছুটা ভিন্ন হলেও ব্যথার রং এক! কলেজ শেষ মানেই বিয়ে! কাকে বিয়ে করবো? কেমন হবে সে? সংসার কেমন চলবে? পাত্র ভালো তো? বিয়ের পরে চাকরি করতে পারবো তো? নাকি রান্নাঘরের চার দেয়ালেই আটকে যাবে স্বপ্ন?

যদি ছেলে চাকরি পায়, তবে সরকারি না বেসরকারি—এ এক বিশাল প্রশ্ন! সরকারি হলে ভাবনার খানিক অবসান, কিন্তু বেসরকারি হলে চিন্তার আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলে! আর যদি ব্যবসা করে, তবে তো চিন্তার সীমা-পরিসীমা নেই! ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, আয়-ব্যয়ের হিসাবের সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির যুদ্ধ চলে নিরন্তর।

বিয়ে হয়ে গেলে কি চিন্তার অবসান হয়? না, তখন নতুন দুশ্চিন্তা এসে দরজায় কড়া নাড়ে। পরিবার, সন্তান, ভবিষ্যৎ, দায়-দায়িত্বের ভার—সব মিলিয়ে জীবনের এক নতুন অধ্যায়।

তারপর বছর ঘুরতেই আসে নাতি-নাতনির মুখ দেখার অপেক্ষা। পরিবার পরিপূর্ণ হলে কি চিন্তা মেটে? না, তখন চিন্তা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে! তারা কি ভালোভাবে মানুষ হলো? ভালো চাকরি পেলো তো? ছেলেমেয়ের বিয়ে, সংসার, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—চিন্তার চাকা অনবরত ঘুরতে থাকে!

শেষ বয়সে এসে শরীর ভেঙে পড়ে। হাঁটতে কষ্ট হয়, চোখে ঝাপসা লাগে, অথচ চিন্তার দৃষ্টি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়! ছেলেমেয়েরা ঠিক আছে তো? বৃদ্ধ বয়সে কে দেখবে? ছেলে-বৌমা কি অবহেলা করবে? নাতি-নাতনিরা কি ভালোবাসবে? আর একসময়, জীবনের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে মনে হয়, ‘এই জীবন কি শুধু চিন্তার জন্যই ছিল?’

চিন্তার জাল কখনও ছিঁড়ে যায় না। সুখের খোঁজে ছুটতে ছুটতে কেবলই এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে উঠতে হয়। অবশেষে, যখন ক্লান্ত শরীর চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ে, তখনই হয়তো শেষ হয় এই দুশ্চিন্তার এক দীর্ঘ অধ্যায়!

তবে সত্যি বলতে, জীবন কি শুধুই চিন্তার খেলা? নাকি তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ভালোবাসা, কিছু হাসি, কিছু সুখের রঙ মিশে থাকে? হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই কেটে যায় এক জীবন…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *