গল্প রহস্যজনক গল্প

নিঃশব্দ খুন – রুপন নাথ

রবিবার দুপুর। রাহুল আর কল্লোল বসে দাবা খেলছিল। খেলা জমে উঠেছে, দুজনেই নিজের নিজের চাল ভেবে নিচ্ছে। হঠাৎ করেই রাহুলের ফোন বেজে উঠল। একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলল সে। রবিবার সাধারণত ফোন আসে না, তাও আবার এই সময়ে।

“হ্যালো, কে?”

ওপাশ থেকে এক চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “রাহুল, আমি সাথী। খুব বিপদে পড়েছি। আমাদের পাড়ায় একটা রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাইরে থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হলেও আমি নিশ্চিত, এটা খুন! তুমি কি একটু আসতে পারবে?”

রাহুল একটু অবাক হলো। “খুন! কীভাবে নিশ্চিত হলে? পুলিশ ডাকোনি?”

“পুলিশ এসেছে, কিন্তু তারা এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই চালিয়ে দিতে চাইছে। আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা গোপন করা হচ্ছে। প্লিজ, তুমি আসবে?”

রাহুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এর মধ্যে সীমান্তিকা এসে পড়েছে, রাহুলের ফোনালাপ শুনে মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। সাথীর সঙ্গে রাহুলের বন্ধুত্ব সীমান্তিকার একেবারেই পছন্দ নয়। অতীতেও এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে তাদের মধ্যে।

“তুমি আবার সাথীর কথায় নাচতে শুরু করেছ? এটা ওর নতুন নাটক, বুঝলে?” সীমান্তিকা রাগী গলায় বলল।

রাহুল বিরক্ত মুখে বলল, “সীমান্তিকা, এটা সিরিয়াস ব্যাপার। একটা মৃত্যু হয়েছে, যদি সত্যি খুন হয়ে থাকে, তাহলে কিছু একটা করতে হবে।”

“সে করবে পুলিশ! তুমি আবার গোয়েন্দাগিরি করতে বেরিয়ো না।”

ঝগড়াটা বাড়তে থাকলে কল্লোল কাশতে কাশতে বলল, “আমাদের দাবা খেলা কি তাহলে আর হচ্ছে না? আমি চলি?”

রাহুল হাসল, “আরে না! খেলা শেষ করেই আমরা বেরোব।”

একঘণ্টা পর তারা রওনা দিল। সাথীর পাড়ায় পৌঁছে রাহুল দেখল যে গলির মধ্যে বেশ ভিড় জমেছে। পুলিশের গাড়ি এক পাশে দাঁড়িয়ে।

“কী হয়েছে?” কল্লোল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

সাথী কাছে এসে বলল, “লোকটার নাম ছিল অনিমেষ সেন। প্রায় ৫০ বছরের মতো বয়স। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন, কারও কোনো শত্রু ছিল না। আজ সকালে ওনার বাড়িতে ওনাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু আমি কিছু সন্দেহ করছি…”

রাহুল চারপাশটা খেয়াল করল। অনিমেষবাবুর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশেপাশের লোকজনের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, কেউ ঠিক নিশ্চিত নয় কী ঘটেছে।

“তুমি কী সন্দেহ করছ?” রাহুল জিজ্ঞেস করল।

সাথী একটু ইতস্তত করে বলল, “ওনার মেয়ে মেঘনা… ও খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছে। বাবা মারা গেছে, অথচ এক ফোঁটা কান্নাও নেই ওর চোখে! বরং বেশ অদ্ভুতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, ও কিছু লুকাচ্ছে।”

রাহুল একটু চিন্তায় পড়ল। এর মধ্যে সীমান্তিকা এসে পাশে দাঁড়াল। “তাহলে এবার তুমি কী করবে গোয়েন্দা বাবু?”

রাহুল হাসল, “প্রথমে মেঘনার সাথে একটু কথা বলা দরকার।”

সে মেঘনার দিকে এগিয়ে গেল। মেঘনা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, ফ্ল্যাটের দরজা হালকা খোলা। রাহুল কাছে যেতেই মেঘনা তাকাল।

“আপনি কে? কেন এসেছেন?”

“আমি রাহুল, এই পাড়াতেই আমার বন্ধুরা থাকে। শুনলাম আপনার বাবার মৃত্যু হয়েছে। খুব দুঃখজনক ঘটনা…”

মেঘনা কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল। রাহুল দেখল, মেঘনার চোখ দুটো লালচে, কিন্তু কাঁদার কোনো চিহ্ন নেই।

“আপনার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে তো?” রাহুল সরাসরি প্রশ্ন করল।

মেঘনা এবার একটু হাসল। “পুলিশ যদি বলে স্বাভাবিক মৃত্যু, তাহলে তাই হবে, তাই না?” তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।

রাহুল একটু অবাক হলো। এতটা ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া কেন?

কল্লোল এসে ফিসফিস করে বলল, “এই মেয়ের চোখে কিছু একটা আছে!”

রাহুল মাথা নাড়ল, “তাই মনে হচ্ছে… আমরা একটু খোঁজ নিতে পারি।”

পরদিন রাহুল খবর পেল যে মেঘনা হঠাৎ করেই শহর ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, কেউ জানে না।

এদিকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এলো—অনিমেষ সেন স্বাভাবিকভাবে মারা যাননি, ওনার শরীরে বিষ পাওয়া গেছে!

রাহুল এবার সত্যি বুঝতে পারল, এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়।

তদন্ত আরও গভীর হতেই বেরিয়ে এলো, অনিমেষ সেনের এক গোপন জীবন ছিল। তিনি একটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিলেন, যেখানে বহু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে, সন্দেহের তালিকায় নতুন তিনজন উঠে এলো—অনিমেষ সেনের পুরনো ব্যবসায়িক পার্টনার তপন বোস, এক অন্ধকারময় ক্যাসিনোর মালিক সমরেশ দত্ত, এবং এক রহস্যময় ব্যক্তি, জনার্দন স্যান্যাল।

রাহুল ও কল্লোল মিলে জনার্দন স্যান্যালের সন্ধান শুরু করল। এক রাতে, তারা গোপন সূত্র থেকে জানতে পারল যে জনার্দন স্যান্যাল এক পুরনো পরিত্যক্ত কারখানায় লুকিয়ে আছে।

অন্ধকার রাতে রাহুল ও কল্লোল সেই কারখানায় পৌঁছাল। তারা ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল, হঠাৎই একটি অস্ত্রধারী লোক তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। “কে তুমি? এখানে কী করছ?”

রাহুল দ্রুত বলল, “আমরা শুধু জানতে চাই অনিমেষ সেনের হত্যার পেছনে কে আছে।”

লোকটি হাসল, “তুমি সত্যি জানার ইচ্ছা রাখো? তাহলে এসো, আমি তোমাকে দেখাই…”

হঠাৎই আলো নিভে গেল। চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল, আর পর মুহূর্তেই একটি গুলি চলল…

রাহুল দ্রুত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, তার কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে। কল্লোল আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করল, “রাহুল! তুমি ঠিক আছো?”

এদিকে খবর পেয়ে সাথী দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায় রাহুলকে। সীমন্তিকা খবর শুনেই ছুটে আসে, সাথীকে দোষারোপ করতে শুরু করে। “তুমি রাহুলকে বিপদে ঠেলে দিয়েছ! সব সময় শুধু নাটক করো!”

তাদের মধ্যে চরম ঝগড়া বাধে, কিন্তু এরই মাঝে রাহুল চোখ খুলে বলে, “তোমরা ঝগড়া না করে বরং আমাকে সাহায্য করো, কারণ আমি সত্যিটা জানতে পেরেছি! খুনি খুবই ধূর্ত, কিন্তু আমি এখন জানি, সে কে!”

চমকপ্রদ সমাপ্তি: এক অবিশ্বাস্য খুনের রহস্য

রাহুলের কাঁধে ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়েছে, কিন্তু চোখে সেই চিরচেনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকেও তার মন খুনির ধূর্ত পরিকল্পনার জট খুলতে ব্যস্ত। সীমান্তিকা আর সাথী তখনো একে অপরের সঙ্গে ঠোঁটকাটা ঝগড়ায় ব্যস্ত, কিন্তু রাহুল হাত তুলে বলল,

“থামো! কারণ খুনি আমাদের মাঝেই আছে!”

সবার মুখে বিস্ময়ের ছাপ। কল্লোল, সাথী, সীমান্তিকা—সবাই তাকিয়ে রইল রাহুলের দিকে।

রাহুল একটু বিরতি নিয়ে বলল, “অনিমেষ সেনকে যে খুন করা হয়েছে, তা তো আমরা সবাই জানলাম। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, তিনি বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—বিষ কীভাবে ওনার শরীরে গেল? খাবারের মাধ্যমে? পানীয়র মাধ্যমে? না! খুনি ওনাকে এমন এক উপায়ে বিষ দিল, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না!”

সবার নিঃশ্বাস আটকে গেল।

“বিষ দেওয়া হয়েছিল… ওনার রোদচশমার ফ্রেমে!”

সাথী হতভম্ব হয়ে বলল, “কী?! চশমার ফ্রেমে বিষ?”

“হ্যাঁ! চশমার ফ্রেমে এমন এক ধরনের বিষ লেপে দেওয়া হয়েছিল, যা শরীরের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে শোষিত হয়। অনিমেষ সেন যেহেতু নিয়মিত সেই চশমা ব্যবহার করতেন, বিষ তার শরীরে প্রবেশ করতে থাকে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে তার স্নায়ুতন্ত্র বিকল হতে শুরু করে। তাই মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। একদম নিখুঁত খুন!”

সীমান্তিকা ফিসফিস করে বলল, “কে করল এটা?”

রাহুল গভীর শ্বাস নিল। “যে কেউ চাইলে অনিমেষ সেনের খাবারে বা পানীয়তে বিষ মিশিয়ে দিতে পারত। কিন্তু খুনি জানত, সেটা করলে সহজেই ধরা পড়ে যাবে। তাই সে এমন একটা উপায় বেছে নিল, যা সাধারণত কেউ সন্দেহই করবে না। আর এই পরিকল্পনা যার মাথা থেকে এসেছে, সে হচ্ছে… তারই মেয়ে, মেঘনা সেন!

ঘরে যেন বিস্ফোরণ ঘটল।

সাথী হতভম্ব হয়ে বলল, “মানে… নিজের বাবাকে খুন করল ও? কিন্তু কেন?”

রাহুল আস্তে আস্তে বলল, “অনিমেষ সেন একটা বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এটা তো আমরা জানতাম। কিন্তু তার পেছনে আরেকটা বড় সত্য লুকিয়ে ছিল। উনি শুধুই প্রতারণা করেননি, বরং নিজের মেয়েকেও ব্যবহার করেছিলেন! মেঘনা ছোটবেলা থেকেই অনিমেষ সেনের অবৈধ কাজে অজান্তে সাহায্য করত। উনি নিজের অবৈধ টাকা লেনদেনের জন্য মেঘনার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতেন। যখন মেঘনা বড় হলো, সে বুঝতে পারল, তার বাবার অপরাধের দায় একদিন তার ওপরেও আসতে পারে। তখনই সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়—সে তার বাবাকে সরিয়ে দেবে!”

কল্লোল ধীরে ধীরে বলল, “অবিশ্বাস্য… মানে মেঘনা জানত, যদি তার বাবা বেঁচে থাকে, তাহলে সে নিজেও পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে! তাই সে নিজের বাবাকেই খুন করল?”

“ঠিক তাই,” রাহুল মাথা নেড়ে বলল। “সে এমন একটা উপায় খুঁজছিল, যাতে খুনটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়। চশমার ফ্রেমে বিষ মাখানোর পরিকল্পনা তার নিজের নয়, বরং জনার্দন স্যান্যালের! জনার্দন নিজে একজন কুখ্যাত অপরাধী, যে অনেকদিন ধরেই অনিমেষ সেনের বিরুদ্ধে সুযোগ খুঁজছিল। মেঘনা যখন তার বাবার বিরুদ্ধে যেতে চাইল, তখন জনার্দন তাকে একটা নিখুঁত পরিকল্পনা দেয়—চশমার ফ্রেমের ভেতর বিশেষ এক ধরনের বিষ লেপে দেওয়া হবে, যা ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করবে। কোনো সন্দেহ হবে না!”

সীমান্তিকা ধীরে ধীরে বলল, “কিন্তু মেঘনা হঠাৎ পালিয়ে গেল কেন?”

রাহুল মুচকি হাসল। “ওর ধারণা ছিল, খুনটা একেবারে নিখুঁত হয়েছে। কিন্তু যখন পুলিশের রিপোর্টে বিষের কথা বেরিয়ে এলো, তখনই ও বুঝল, ও ধরা পড়তে পারে। তাই জনার্দন ওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করল। কিন্তু আমি যখন ওর চোখের দিকে তাকালাম, তখনই বুঝলাম, ও কিছু লুকাচ্ছে।”

“এখন তাহলে আমাদের কী করা উচিত?” সাথী জিজ্ঞেস করল।

রাহুল চোখ বন্ধ করে বলল, “জনার্দন স্যান্যাল এখনো বেঁচে আছে, আর সে যতদিন বাইরে থাকবে, ততদিন মেঘনা ধরা পড়বে না। আমাদের এখন জনার্দনকে ধরতে হবে!”

সীমান্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আবার বিপদের মুখে ঝাঁপ দিতে চাও?”

রাহুল হাসল। “সত্যি জানার জন্য কিছু ঝুঁকি নিতেই হয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *