পুরাণ অনুসারে আত্মার কোনদিন জন্ম হয় না। আত্মার কোনও মৃত্যুও নেই, কোন আত্মা থেকে কোনদিন নতুন আত্মা সৃষ্টি হতে পারে না। আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। আত্মা কেবল শরীর ধারণ করে মাত্র। তারপর পৃথিবীতে তার কার্যকালের মেয়াদ শেষ হলে সেই শরীর ত্যাগ করে। আবার যতক্ষণ না আত্মা তার কর্মফল ভোগ সম্পন্ন করে মোক্ষ লাভ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে থাকে। অর্থাৎ আত্মার সংখ্যা কোনদিন বাড়ে না। আত্মা কেবল তার শরীর পরিবর্তন করে। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, আত্মার সংখ্যা যদি না বাড়ে, তাহলে জনসংখ্যা বাড়ছে কি করে?
আত্মা অবিনশ্বর। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, আত্মা কর্মচক্রে আবদ্ধ থাকে এবং বারংবার জন্ম নিতে থাকে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, নতুন আত্মার সৃষ্টি হচ্ছে। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, আত্মার যদি মৃত্যু না ঘটে এবং সেই আত্মাই কেবল জন্মগ্রহণ করে, নতুন করে কোন আত্মার সৃষ্টি হয় না। তাহলে জনসংখ্যা বাড়ছে কি করে? জনসংখ্যা নিশ্চয় বাড়ার কথা নয়?
আজ আমরা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও পৌরাণিক ভিত্তিতে বোঝার চেষ্টা করবো।
পুরাণ অনুসারে, জীবাত্মাকে মোট 84 লক্ষ যোনিতে জন্মানোর পরে অবশেষে মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়। এর মধ্যে 20 লক্ষবার জন্ম বৃক্ষযোনিতে। এই জন্মে রোদ, ঝড়, বৃষ্টি বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সহ্য করতে হয়।
9 লক্ষবার জন্ম নিতে হয় জলচর রূপে। এই রূপে একজনের মাংস আর একজন ভক্ষণ করে জীবন অতিবাহিত করে।
ক্রিমি বা কীটপতঙ্গ যোনিতে জন্মাতে হয় 11 লক্ষ বার। 10 লক্ষবার পাখিরূপে এবং পশু যোনিতে জন্মাতে হয় 30 লক্ষ বার। এরপর মানবরূপে জন্ম গ্রহণ করতে হয় 4 লক্ষ বার।
সর্বপ্রথম আত্মা বৃক্ষ রূপে জন্মগ্রহণ করে। এই যোনিতে মোট 20 লক্ষবার জন্ম গ্রহণ করতে হয়। প্রথমে সে নানারকম লতাপাতা, বড়ো বড়ো গাছপালা রূপে জন্মগ্রহণ করে। রোদ ঝড় বৃষ্টিতে সে কষ্ট ভোগ করে। অবশেষে সে তুলসী রূপে জন্মগ্রহণ করে। এরপর 9 লক্ষ বার জলাচর যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়।
মাছ কুমির কচ্ছপ ইত্যাদি রূপে সে জন্ম পেতে থাকে।
এখানে বড়ো বড়ো প্রাণীরা তাদের হত্যা করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর তারা কৃমিযোনিতে প্রবেশ করে। এই যোনিতে সে মলমূত্র, আবর্জনায় বসবাস করে এবং সেই সমস্ত খাদ্যগ্রহণ করে। এমনকি কৃমিযোনিতে একটি কৃমি অপর কৃমিকে ভক্ষণ করে। অবশেষে সেই আত্মা বজ্রকীট রূপে জন্মগ্রহণ করে।
এই কীট যখন শিলাকে কুরে কুরে খায় তখন সেই শিলা নারায়ণ শিলায় রূপান্তরিত হয়। ফলে সেই আত্মা কৃমি যোনি থেকে মুক্তি লাভ করে।
11 লক্ষ বার কৃমি যোনিতে জন্মানোর পর 10 লক্ষ বার পক্ষীযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়। পক্ষী জীবনে আত্মার কোন নির্দিষ্ট গৃহ থাকে না। গাছের ডালে ডালে বাসা বানায়। রোদ ঝড় বৃষ্টিতে কষ্ট পেতে হয়, বাসা ভেঙে যায়। এরই সাথে ফল, পোকামাকড় খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
এইভাবে পক্ষীযোনিতে জন্মানোর পর অবশেষে মুযুরপক্ষী রূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়।
এরপর সেই আত্মা পশুযোনিতে প্রবেশ করে। এই যোনিতে আত্মাকে 30 লক্ষবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। অবশেষে সেই আত্মা গরু রূপে জন্মগ্রহণ করে।
এরপর, আত্মা মনুষ্যযোনিতে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। এই আত্মাকে মনুষ্যরূপে 4 লক্ষবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। এই যোনিতে জন্মানোর পর আত্মা বিভিন্ন রকম পাপ পুন্য করার পর জন্ম জন্মান্তর ধরে কর্মফলের উপর নির্ভর করে জন্মগ্রহণ করতে হয়। মনুষ্যরূপে যখন আত্মা জন্মগ্রহণ করে, তখন সর্বপ্রথম সে নিম্নমানের জীবনযাত্রা লাভ করে, এরপর সেই আত্মা মনুষ্যরূপে কি কর্ম করেছে, তার উপর নির্ভর করে উচ্চস্তরের জীবনযাত্রা লাভ করে। অবশেষে যখন তার কর্মফল ভোগ সম্পন্ন হয়, তখন আত্মা পরমাত্মার সাথে বিলীন হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রথমাবস্থায় কেন আত্মাকে নিম্নমানের জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
আপনারা দেখবেন, আমরা যখন প্রথম কোনো কার্য করি, তখন কিন্তু নিঁখুত ভাবে সেই কার্যটি সম্পন্ন হয় না। অনেক ভুল ত্রুটি থেকে যায়। সেইগুলিকে অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে উন্নত করে তুলি। ঠিক একইভাবে মানুষ প্রথমে নিম্ন স্তরের জীবনযাত্রা অতিবাহিত করে। এরপর সেই আত্মা ধীরে ধীরে উচ্চস্তরের জীবন অতিবাহিত করে।
এবার জানা যাক, মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে কি করে? হিন্দু পুরাণ অনুসারে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে চারটি যুগ রয়েছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ। প্রতিটি যুগকে ভগবান ব্রহ্মার এক একটি দিন বলে মনে করা হয়। প্রতিটি যুগের শেষে ভগবান ব্রহ্মা যখন ঘুমিয়ে পড়েন, তখন সেই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। আবার তিনি যখন জাগ্রত হন, তখন নতুন যুগের সূচনা হয়। যখন একটি যুগের সূচনা হয়, তখন পৃথিবীতে প্রাণীর সংখ্যা খুবই কম থাকে। তারপর তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। প্রতিটি জীব ব্রহ্মলোকে বাস করে। তারপর নিজ কর্ম অনুযায়ী, সে এই পৃথিবীতে জন্মলাভ করে।
প্রতিটি আত্মাকেই এই পৃথিবীতে 84 লক্ষবার জন্ম নিতে হয়। একটি যোনিতে জন্মচক্র শেষ হলে পরবর্তী যোনিতে তার জন্মচক্র শুরু হয়। এইভাবে ধীরে ধীরে সে মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করে। মনুষ্য জন্মের প্রতিটি পরিবারের জীবিত সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ্য সদস্যের পূর্ববর্তী তিনজন সদস্য পিতৃলোকে বাস করে। এরপর যখন পরিবারের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ্য সদস্যের মৃত্যু ঘটে তখন পিতৃলোকের একজন আত্মার মুক্তি ঘটে এবং পৃথিবীতে তিনি পুনরায় জন্মগ্রহন করেন।
আমাদের পৃথিবীতে মোট কতজন মানুষ আছে তার হিসেব করা যায়। কিন্তু কত প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবীতে আছে তার হিসেব কিন্তু কেউ বলতে পারে না।
বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীর আত্মা তাদের যোনিচক্র থেকে মুক্তিলাভ করে মনুষ্যযোনিতে জন্ম নিয়েছে। সেই কারণেই মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যখন কলিযুগ অন্তিমলগ্নে পৌঁছাবে, তখন প্রায় প্রতিটি প্রাণী যোনিচক্র থেকে মুক্তি পেয়ে মনুষ্যযোনি লাভ করবে। এরফলে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা কমতে থাকবে।
বৈজ্ঞানিক ভাষায়, সেই সময় প্রাণী ও উদ্ভিদের তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। যার ফলে বাস্তুতন্ত্র একেবারেই ভেঙে পড়বে। ফলে মানুষ ও এই সৃষ্টির ধ্বংস অবসম্ভাবি হয়ে দাঁড়াবে।
আবার অপরদিকে হিন্দু পুরাণ অনুসারে, যখন মনুষ্যজন্মের পূর্ববর্তী প্রতিটি যোনিতে জন্মগ্রহণ সম্পর্ণ করে আত্মা মনুষ্য জন্ম লাভ করবে, তখন এই জন্মচক্রের বন্ধন থেকে সে মুক্তি লাভ করবে। সেই এই কলিযুগের সমাপ্তি ঘটবে এবং নতুন যুগের সূচনা হবে। আত্মা অবিনশ্বর, অমর তাই আত্মা এই পৃথিবীতে একটি যোনি চক্র থেকে মুক্তি লাভ করে পরবর্তী যোনিচক্রে জন্মলাভ করে। ধীরে ধীরে আত্মার যোনিচক্রের উন্নতি ঘটে। ফলে তারা মনুষ্য জন্ম লাভ করে। এই কারণেই একদিকে যেমন বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা কমছে। ঠিক অন্যদিকে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
এরথেকে এটাই বোঝ যায়, আত্মার সংখ্যা একই আছে। কেবল আত্মার যোনিচক্রের পরিবর্তন ঘটছে।