গল্প রহস্যজনক গল্প

মৃত্যুর সমীকরণ – রুপন নাথ

সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে আসছে। কলকাতার এক প্রাচীন ক্যাফেতে বসে আছি আমি, প্রফুল্ল চন্দ্র। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এক দৃষ্টিতে গল্পের বইয়ের পাতায় হারিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করেই, এক তরুণ এসে আমার সামনে বসে পড়ল। রোগা করে, কিন্তু চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ঝলক।

  • “এক্সকিউজ মি, এই টেবিলটা আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য রাখা আছে। একটু জায়গা ছেড়ে দেবেন?”

আমি ট্যারা স্বভাবের লোক। সহজে কারও কথায় উঠি না। মুচকি হেসে বললাম, “দুঃখিত ভাই, আমি একবার বসলে আর উঠি না।”

তরুণটা বিরক্ত হলো, কিন্তু কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পরই ক্যাফের দরজা ঠেলে ভেতরে এলো এক মেয়ে। সুঠাম গড়ন, আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি, ডাক্তারি পেশার গাম্ভীর্য তার চোখেমুখে ফুটে রয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, এই তরুণের গার্লফ্রেন্ড এসে গেছে। আমি এবার আস্তে করে জায়গা ছেড়ে দিলাম।

তারা নিজেদের মধ্যে গম্ভীর আলোচনায় মগ্ন হয়ে গেল। আমার কৌতূহল হলো। কী এমন গুরুতর আলোচনা? আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম,

  • “দুঃখ করবেন না, কিন্তু কী নিয়ে কথা বলছেন?”

তারা দু’জন প্রথমে বিরক্ত হলো। কিন্তু আমি সহজে ছাড়ার পাত্র নই। বললাম, “শুনুন, আমি ডিটেকটিভ কাহিনি পড়তে ভালোবাসি। রহস্যের পেছনে দৌড়ানোর এক আলাদা রোমাঞ্চ আছে। কিন্তু তোমরা আমাকে বলছ না। নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো কেস!”

তরুণটি বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই ব্যোমকেশ বক্সীর মতো নিজের মাথা ঠান্ডা রাখেন না।”

আমি হেসে বললাম, “তুমি কি ব্যোমকেশের মতো মেধাবী? নাকি একেবারেই শার্লক হোমসের পথ অনুসরণ করো?” আমার কথা শুনে ছেলেটি আর থাকতে পারল না। মেয়েটি, অর্থাৎ সীমন্তিকা, তাকে শান্ত করল।

এরপর শুরু হলো গল্প।

রাহুল লালবাজার থানার গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। সীমন্তিকা একজন ডাক্তার। গত দশ দিনে কলকাতায় দুটি খুন হয়েছে, রহস্যের কিনারা পাচ্ছে না পুলিশ। রাহুলের উপর এই কেসের দায়িত্ব পড়েছে। আর আমি? আমাকে একরকম ডিল করিয়েই নিল ওরা। সমস্ত রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব আমার—লেখক হিসেবে আমাকে লিখতে হবে, নথিভুক্ত করতে হবে প্রতিটি ঘটনার বিবরণ।

রাত বাড়তেই রাহুল বলল, “প্রফুল্লদা, আমরা যখন এই কেস নিয়ে কথা বলছি, তখনই হয়তো খুনি আরেকটা হত্যার পরিকল্পনা করছে। আমাদের সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।”

এই বলে তারা বেরিয়ে পড়ল। আর আমিও। কারণ, আমি শুধু দর্শক নই, এই কাহিনির সাক্ষীও।

খুনের ছায়া:

খুনের ধরন অদ্ভুত। দুটি খুনই হয়েছে মধ্যরাতে। প্রথম খুনটি হয়েছিল ভবানীপুরের এক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে। ভুক্তভোগী ছিলেন নামকরা ব্যবসায়ী মিস্টার দেবাশীষ সেন। দ্বিতীয় খুনটি ঘটেছিল পার্কস্ট্রিটের এক নির্জন রাস্তায়। মৃত ব্যক্তি ছিলেন এক তরুণী—সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, কোনো বড়সড় শত্রুতার ইতিহাস নেই।

পুলিশের কাছে কোনো দৃশ্যমান ক্লু নেই। শুধু একটা মিল পাওয়া গেছে—প্রত্যেক খুনের স্থানে পাওয়া গেছে একরকম অদ্ভুত লাল রঙের একটি ছোট কাগজ। তাতে লেখা ছিল এক রহস্যময় সংখ্যা, “৭১/২৯”।

রাহুল বলল, “এই সংখ্যার মানে কী? কেন খুনের পরে এই সংকেত রেখে যাচ্ছে খুনি?”

সীমন্তিকা বলল, “প্রত্যেক হত্যার সময়কাল একদম নির্দিষ্ট। এটা কোনো পেশাদার খুনির কাজ, যিনি নিজের পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করছেন।”

আমি বললাম, “খুনি যদি এতই নিখুঁত হয়, তবে আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রত্যেক সন্দেহভাজনের দিকে নজর দিতে হবে।”

রাহুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “সন্দেহভাজন কিন্তু ছয় থেকে সাতজন। প্রত্যেকেরই মোটিভ থাকতে পারে, প্রত্যেকেই সন্দেহজনক!”

আমরা প্রত্যেক সন্দেহভাজনকে একে একে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে গেলাম দেবাশীষ সেনের অফিসে। সেখান থেকে জানা গেল, তিনি সম্প্রতি কিছু বড় ব্যবসায়িক শত্রু বানিয়েছিলেন।

তার ব্যক্তিগত সহকারী এক মহিলা, নাম অনন্যা, জানালেন, “স্যার কিছুদিন আগে এক অজ্ঞাত ফোন পেয়েছিলেন। ওনার মুখের ভাব দেখে মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস।”

আমরা এরপর তরুণীর পরিচয় জানতে পারলাম। তার নাম ছিল রিয়া দত্ত। সে একটি গোপন তদন্ত চালাচ্ছিল, যা তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।

নতুন হত্যার ঘটনা:

ঠিক তখনই খবর এল, আরও একটি খুন হয়েছে! এবার শিকার এক উঁচু পদস্থ পুলিশ অফিসার, যিনি এই কেসের তদন্তে সহায়তা করছিলেন। তার শরীরে পাওয়া গেল সেই একই সংকেত, “৭১/২৯”।

রাহুল ধমক দিয়ে বলল, “খুনি আমাদের কাছাকাছি! যে-ই হোক না কেন, আমাদের গতিবিধি জানে। এটা ব্যক্তিগত আক্রমণের ইঙ্গিত।”

সীমন্তিকা বলল, “এবার আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। এটা শুধু সাধারণ খুন নয়, বরং বড় কোনো ষড়যন্ত্র।”

আমরা আরও গভীরে যেতে থাকলাম, এবং বুঝতে পারলাম, সংঘটনের আসল পরিকল্পনা সামনে আসতে শুরু করেছে।

সংঘটনের রহস্য:

আমরা জানতে পারলাম, একটি গোপন সংঘঠন “অগ্নিসংহতি” কলকাতা শহরে অপরাধের শিকড় গেড়ে বসেছে। এরা উচ্চবিত্ত সমাজের কুটিল লোকদের দ্বারা পরিচালিত, এবং প্রতিটি খুনের পেছনে এদের গভীর হাত থাকতে পারে। সন্দেহভাজনদের তালিকায় যোগ হলো দু’জন—ডন অরুণেশ সেন ও এক ব্যবসায়ী অজয় চক্রবর্তী।

ঠিক তখনই রাহুলের ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ বলল, “তোমরা যত কাছাকাছি আসবে, তত বেশি বিপদের মধ্যে পড়বে… এবার পালা তোমাদের।”

রাহুল ফোন রেখে সীমন্তিকার দিকে তাকাল। আমরা বুঝতে পারলাম, এবার শিকার আমরা নিজেই…

রহস্যের সমাপ্তি

রাহুল ফোন রেখে সীমন্তিকার দিকে তাকাল। তার চোখে উদ্বেগের ছায়া। আমি বুঝলাম, খুনি আমাদের গতিবিধির উপর নজর রাখছে। আমরা কি সত্যিই তার এত কাছাকাছি চলে এসেছি?

আমরা তৎক্ষণাৎ লালবাজারের গোয়েন্দা দপ্তরে ফিরে গেলাম। খুনের ক্লু, সন্দেহভাজনদের তথ্য, সব কিছু ছড়িয়ে রাখলাম টেবিলে। খুনের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম।

হত্যার ধরন:

প্রতিটি খুন পরিকল্পিত। মৃতদেহগুলোর শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন নেই, কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্টে দেখা গেল, প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে এক ধরনের বিষক্রিয়ায়। বিষটির নাম “রেড মিরেজ”—একটি অত্যন্ত বিরল ও দ্রুত কাজ করা বিষ, যা সাধারণত গবেষণাগারে তৈরি হয় এবং শরীরে প্রবেশের পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকে ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। তবে এই বিষ ব্যবহারের পদ্ধতিতে মিল ছিল। প্রত্যেক শিকার খাওয়ার বা পানীয় গ্রহণ করার পরই মৃত্যুবরণ করেছে।

৭১/২৯ এর অর্থ:

আমি নম্বরটি নিয়ে ভাবতে লাগলাম। রাহুল বলল, “কোনো গাণিতিক সংকেত হতে পারে?”

আমি তখনই নোটবুক বের করলাম। কলকাতার পুরনো মানচিত্র ঘেঁটে দেখলাম, ৭১/২৯ কোঅর্ডিনেট অনুসারে একটি পুরনো বিল্ডিংয়ের অবস্থান পাওয়া যাচ্ছে। বিল্ডিংটি একসময় একটি ঔষধি গবেষণাগার ছিল, যা কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়।

রাহুল বলল, “এটাই তাহলে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।”

সংঘটনের আসল রূপ:

আমরা যখন সেই বিল্ডিংয়ে পৌঁছালাম, তখন রাত গভীর। ভবনের ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম, একটি গোপন ল্যাবরেটরি এখনো সচল। টেবিলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ও পরীক্ষার নমুনা। হঠাৎ করেই আমাদের সামনে এল সেই ব্যক্তি, যাকে আমরা খুঁজছিলাম—ডন অরুণেশ সেন!

তিনি শান্ত স্বরে বললেন, “তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তোমরা যদি সত্যিই রহস্য উন্মোচন করতে পারো, তবে এই রাত তোমাদের শেষ রাত হবে।”

আমাদের চারপাশে কিছু অস্ত্রধারী ব্যক্তি ঘিরে ফেলল। রাহুল অস্ত্র বের করতেই গুলি ছুটল! আমরা দ্রুত আড়াল নিলাম। ঠিক সেই সময়ে সীমন্তিকা বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ল্যাবরেটরিতে যে বিষ তৈরি হচ্ছে, সেটাই খুনের অস্ত্র!”

আমি বুঝতে পারলাম, খুনের আসল রহস্য। অরুণেশ সেন এই ল্যাবের মাধ্যমে অবৈধ ওষুধ ও বিষ তৈরি করতেন, যা কালোবাজারে বিক্রি হত। দেবাশীষ সেন এবং রিয়া দত্ত এই গোপন কর্মকাণ্ড ফাঁস করতে চেয়েছিলেন। তাই তাদের খুন করা হয়েছিল। আর পুলিশ অফিসার? তিনি এই চক্রের অন্যতম প্রধান তথ্যদাতা ছিলেন, তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চূড়ান্ত সংঘর্ষ:

আমরা দৌড়ে ল্যাবরেটরির বাইরে বের হতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু গুলি ছুটে এল। রাহুল পাল্টা গুলি চালিয়ে একজনকে আহত করল। সীমন্তিকা আমাদের বলল, “ওই বোতলগুলোর দিকে তাকাও! যদি কোনোভাবে এই ল্যাব ধ্বংস করা যায়, তবে এদের চক্র শেষ হয়ে যাবে।”

আমি বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটি রাসায়নিকের বোতলে আগুন ধরালে পুরো ল্যাব ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি দ্রুত একটি লাইটার জ্বালিয়ে রাসায়নিকের উপরে ছুঁড়ে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটল! পুরো ভবন কেঁপে উঠল। আমরা কোনওমতে দৌড়ে বাইরে বের হয়ে এলাম।

পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেল। অরুণেশ সেন এবং তার সহযোগীদের গ্রেফতার করা হলো। কলকাতার সবচেয়ে জটিল খুনের রহস্য উন্মোচিত হলো।

রাহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এবার অন্তত কয়েকদিন বিশ্রাম নেওয়া যাবে।”

আমি হাসলাম, “কিন্তু রহস্যের নেশা ছাড়বে না, তাই তো?”

সীমন্তিকা বলল, “তোমরা দু’জন সত্যিই রহস্য সমাধানের পোকা। তবে এবার একটু বিশ্রাম নাও।”

কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, এই কাহিনির সমাপ্তি এখানেই নয়। কারণ, অন্ধকারের কোণে এখনও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *