পুরুলিয়ার নির্জন পথ ধরে ছুটছিল গাড়িটা। চারপাশের অন্ধকার যেন ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছিল। রাত তখন ঠিক নয়টা। হঠাৎ করেই গাড়ির ইঞ্জিন গড়গড় শব্দ করে থেমে গেল। জয়ন্ত একবার স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে সবাই নেমে পড়ল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর হালকা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
ঠিক তখনই… একটা চাপা পায়ের শব্দ শোনা গেল। মাথার ওপরে আধখানা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে, তার আলোয় দেখতে পেল এক বৃদ্ধ ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। গায়ে ময়লা ছেঁড়া ধুতি, চোখ দুটো যেন গর্তের মতো গভীর। বৃদ্ধ কোনো কথা না বলে কেবল হাত তুলে সামনের দিকে ইশারা করল। সেখানে একটা ছায়াময় বিল্ডিং দাঁড়িয়ে ছিল, অন্ধকারের মধ্যে যেন এক বিভীষিকা।
“এখানে থাকতে পারো,” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল বৃদ্ধ।
অরুণ জিজ্ঞেস করল, “গাড়ির কী হবে?”
বৃদ্ধ বলল, “ভোর হলে ঠিক হয়ে যাবে… কিন্তু এখন তোমাদের এখানেই থাকতে হবে।”
বিকল্প না দেখে ওরা চারজন বৃদ্ধের দেখানো পথ ধরে বিল্ডিংয়ে ঢুকল। আশ্চর্যের বিষয়, দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে চারপাশটা দেখতে লাগল। দেয়ালে পুরনো ছবি, মলিন পর্দা, বাতাসে একটা চাপা পচা গন্ধ—যেন বহু বছর ধরে কেউ এখানে থাকেনি।
শর্মিষ্ঠা ও জয়ন্ত একটি ঘরে, আর সুতপা ও অরুণ আরেকটি ঘরে ঢুকল। বিছানার চাদর মলিন, জানালার কাচে ধুলো জমে রয়েছে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওরা আর কিছু ভাবতে পারল না।
রাত তখন বারোটা।
শর্মিষ্ঠা গভীর রাতে হঠাৎ পায়ের খসখস শব্দে জেগে উঠল। সে প্রথমে মনের ভুল মনে করল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার সেই শব্দ শুনে জয়ন্তকে ডাকল।
“জয়ন্ত, শুনতে পাচ্ছো?”
জয়ন্ত ঘুমজড়ানো গলায় বলল, “হুমম… কি হলো?”
“শব্দটা শুনতে পাচ্ছো না?”
জয়ন্ত উঠে বসতেই খেয়াল করল, ঘরটা আগের চেয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটা অজানা শিহরণ বয়ে গেল তার শরীরের উপর দিয়ে।
“বোধহয় বাতাসের শব্দ,” বলল জয়ন্ত।
শর্মিষ্ঠা ধীরে ধীরে জয়ন্তর কাছে এগিয়ে এল। ওর শরীরের উষ্ণতা, নিঃশ্বাসের ছোঁয়া জয়ন্তকে কেমন যেন অস্থির করে তুলল। শর্মিষ্ঠার চোখে অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছিল।
“তুমি জানো, এমন রাতে অন্ধকারের মাঝেও উষ্ণতার প্রয়োজন হয়…” শর্মিষ্ঠা ফিসফিস করে বলল।
জয়ন্ত এক মুহূর্তের জন্য সব কিছু ভুলে শর্মিষ্ঠাকে জড়িয়ে ধরল। তার তপ্ত ঠোঁট স্পর্শ করল শর্মিষ্ঠার নরম ঠোঁট। তারা একে অপরকে তীব্র উন্মাদনায় চুম্বন করতে লাগল। জয়ন্তর হাত শর্মিষ্ঠার কোমরে বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছিল।
ঠিক তখনই, দরজার কড়া নড়ে উঠল।
শর্মিষ্ঠা আতঙ্কে জয়ন্তর বুকের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। জয়ন্ত ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা ঘরে ঢুকে পড়ল। আর তখনই দেখা গেল একজোড়া কালো হাত দরজার দু’পাশ থেকে বেরিয়ে এসে জয়ন্তকে আঁকড়ে ধরল।
জয়ন্ত চিৎকার করার আগেই, সেই অশরীরী হাত তার গলা জড়িয়ে ধরল। শর্মিষ্ঠা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তু তার গলায় কোনো আওয়াজ বের হলো না। যেন তার গলার স্বর কেউ কেড়ে নিয়েছে।
পরের মুহূর্তে, সব অন্ধকার হয়ে গেল।
সকালে শর্মিষ্ঠার জ্ঞান ফিরল। সে নিজেকে নগ্ন ও রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখল। কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকাল। খাটের পাশে পড়ে রয়েছে জয়ন্ত, তার মাথার পেছনটা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তা বিকৃত করে দিয়েছে।
সে দ্রুত অরুণ ও সুতপার ঘরের দিকে ছুটল। দরজায় ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেল, আর সে দেখে ভেতরে বিভীষিকাময় দৃশ্য। সুতপা অর্ধনগ্ন, তার গলা কালো দাগে ঢাকা, চোখ খোলা কিন্তু প্রাণহীন। আর এক কোণে পড়ে রয়েছে অরুণের শরীর, যার গলার নলি ছিঁড়ে গিয়েছে।
শর্মিষ্ঠা পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে লাগল। অন্ধকার পথ ধরে ছুটতে ছুটতে সে তার গাড়ির কাছে পৌঁছল। আশ্চর্যের বিষয়, গাড়ির ইঞ্জিন নিজে থেকেই চালু ছিল। সে দ্রুত দরজা খুলে স্টিয়ারিং ধরল, গাড়ি চালিয়ে মরিয়া হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারল, তার শরীরে কে বা কারা অদৃশ্যভাবে স্পর্শ করছে। মনে হচ্ছিল, কেউ তার পাশে বসে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে। হঠাৎ রিয়ারভিউ মিররে চোখ পড়তেই সে দেখল—পিছনের সিটে সেই বৃদ্ধ বসে আছে, তার শূন্য চোখদুটি সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে।
গাড়ি প্রচণ্ড বেগে চলছিল, আর শর্মিষ্ঠার দৃষ্টির সামনে আস্তে আস্তে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছিল…
সেই রাতে পুরুলিয়ার সেই পথ দিয়ে আর কেউ যায়নি। শোনা যায়, মাঝরাতে সেখানে কোনো এক নারীর আতঙ্কিত আর্তনাদ ভেসে আসে, আর কোনো এক বৃদ্ধের চাপা হাসি বাতাসে মিলিয়ে যায়।