গল্প ভৌতিক গল্প

বিয়ের রাতের আকর্ষণ

বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছে। বিয়ের ঘর মানেই হাসি-ঠাট্টা, হৈ-হুল্লোড় আর নতুন সম্পর্কের সূচনা। কিন্তু আবির এসবের মধ্যে নেই। সে একটু নিভৃতচারী প্রকৃতির। বড়দের সম্মান রেখে সে এসেছে, তবে মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিথিরা বিদায় নিচ্ছে। একটা কোণের দিকে দাঁড়িয়ে আবির মোবাইল ঘাঁটছিল। এমন সময় তার কানে এলো চুড়ির টুংটাং শব্দ। চোখ তুলে দেখল—একটা মেয়ে লম্বা খোলা চুল, গাঢ় নীল শাড়ি পরে সামনে দিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় মেয়েটাকে অপার্থিব সুন্দর লাগছিল।

মেয়েটা একটু ফিরে তাকাল, চোখে রহস্যময় হাসি। আবিরের মনে হলো, এই হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু একটা। কিন্তু কী?


প্রথম আলাপ

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ। কিছু আত্মীয়-স্বজন এখনো আড্ডায় ব্যস্ত। আবিরের খেয়াল থাকল না, কখন মেয়েটা আবার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

“তুমি এত চুপচাপ কেন?” মেয়েটার কণ্ঠস্বর ছিল মিষ্টি কিন্তু দৃঢ়।

আবির একটু হাসল, “তোমার মতো সুন্দরী কেউ পাশে থাকলে চুপচাপ থাকাই ভালো। বেশি কথা বললে ভাব নেওয়া মনে হতে পারে।”

মেয়েটা মুচকি হাসল, চোখে দুষ্টুমি। “তাহলে ভাবই নাও না! তাতে ক্ষতি কী?”

আবির বিস্মিত হলো। এত খোলামেলা কথা বলার মেয়ে সে খুব একটা দেখেনি।

“তোমার নাম কী?”

“সায়নী।”

“তুমি কনের কী হয়?”

“খুব দূর সম্পর্কের বোন। আমাকে কেউ চেনে না এখানে, তুমিও চিনতে না।”

আবির অবাক হলো, “তুমি কি সত্যিই আত্মীয়, নাকি অন্য কিছু?”

সায়নী একটু হাসল। “সেটা সময় বলে দেবে।”

গল্পের মাঝে কখন যে রাত বেড়ে গেছে, খেয়ালই ছিল না।


নীরবতার ডাক

রাত তখন প্রায় দুটো। বেশিরভাগ লোক ঘুমিয়ে পড়েছে।

সায়নী হঠাৎ বলল, “চলো, ছাদে যাই।”

আবির দ্বিধান্বিত হলো, কিন্তু সায়নীর চোখে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। যেন সে কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

ছাদটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল। বাতাস বইছে ধীরে ধীরে।

“তুমি কি সবসময় এতটা সিরিয়াস?” সায়নী জানতে চাইল।

আবির তাকাল, “তুমি কি সবসময় এত রহস্যময়?”

সায়নী একটু হেসে বলল, “আমাকে দেখে তোমার মনে কী হয়?”

আবির গভীরভাবে তাকিয়ে থাকল। “তুমি বাস্তবের মানুষ না কি গল্পের চরিত্র, বুঝতে পারছি না।”

সায়নী চোখ সরিয়ে নিল। “তোমার মনে হয়, কিছু মানুষ শুধু এক রাতের জন্য আসে? কারও জীবনে?”

আবির একটু চুপ করল। “মানে?”

সায়নী ধীরে ধীরে বলল, “আজকের রাতটা মনে রেখো। হয়তো এর পর আর কোনোদিন দেখা হবে না।”

আবিরের গলা শুকিয়ে গেল। “তুমি কোথায় চলে যাবে?”

সায়নী হালকা হেসে বলল, “সময় হলে জানতে পারবে।”

সায়নী সামনে এগিয়ে এল। তাদের মাঝে একটুও দূরত্ব রইল না। আবির টের পেল, তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার শরীর থেকে অদ্ভুত এক গন্ধ আসছে—কেমন যেন মিষ্টি, অথচ তার মধ্যে একটা কাঁচা রক্তের গন্ধও মিশে আছে।

আবির নিজেকে সরাতে চাইলো, কিন্তু পারল না। সায়নী তার গলা ছুঁয়ে বলল, “তুমি ভয় পাচ্ছ?”

আবির কিছু বলার আগেই সে আবিরের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল। সেই চুম্বন ছিল শীতল, অথচ তার মধ্যে যেন এক অতল গভীরতা লুকিয়ে ছিল। মুহূর্তেই আবির অনুভব করল, তার সমস্ত শক্তি কোথাও শুষে যাচ্ছে।

তার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো। শেষবারের মতো সে দেখল—সায়নীর চোখ এখন আগুনের মতো জ্বলছে, ঠোঁটের কোণে লাল রক্তের রেখা।


অপ্রত্যাশিত সত্য

পরদিন সকালে আবিরের ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে। গত রাতের ঘটনাগুলো স্বপ্ন ছিল, না সত্যি, বোঝা মুশকিল।

বিয়ের বাড়ির লোকজন ব্যস্ত, কিন্তু কোথাও সায়নী নেই।

সে কনের বোনদের জিজ্ঞাসা করল, “সায়নী কোথায়?”

সবাই অবাক হয়ে তাকাল। “সায়নী? এই বাড়িতে তো এমন কেউ নেই।”

আবির হতভম্ব। “কী বলছ! গত রাতে… আমি…!”

একজন বয়স্ক আত্মীয় বললেন, “বছর দশেক আগে এই বাড়িতে একটা মেয়ে ছিল, যার নাম সায়নী। কিন্তু একটা দুর্ঘটনায়… ও মারা যায়।”

আবিরের মাথা ঘুরতে লাগল। তাহলে গত রাতের মেয়েটা…?

সে ছাদের দিকে তাকাল। জানালার পর্দা উড়ছে, হাওয়ায় যেন কারও চুড়ির টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে…


শেষ প্রশ্ন

আবির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গলা দেখল। সেখানে ক্ষতচিহ্নের মতো লাল দাগ, যেন কেউ তার শরীর থেকে কিছু শুষে নিয়েছে।

তার চোখ দুটো কেমন যেন বদলে যাচ্ছে… ভিতরে ভয় আর অদ্ভুত এক আকর্ষণ জেগে উঠছে।

সে কি সায়নীকে সত্যিই হারিয়েছে? নাকি… সে নিজেই এখন অন্য এক জগতে পা রাখতে চলেছে?

অশরীরীর পরিণয়

রাত যত গভীর হয়, আবীরের কানে যেন মৃদু এক মেয়েলি হাসির শব্দ ভেসে আসে। প্রথমে সে ভেবেছিল, এটা তার কল্পনা মাত্র। কিন্তু ধীরে ধীরে শব্দটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

এক রাতে, ঘরের জানালার পর্দা আচমকা উড়ে যায়। আবীর তাকিয়ে দেখে, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী। তার চোখ গভীর, মুখে এক রহস্যময় হাসি।

“কে তুমি?” ফিসফিস করে জানতে চায় আবীর।

মেয়েটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। চাঁদের আলোয় তার শরীর যেন মোমের মতো জ্বলজ্বল করছিল।

“আমি সায়নী… তোমার জন্য এসেছি…”

আবীরের শরীর শিহরিত হয়। সে অনুভব করে, মেয়েটির শরীর থেকে আসা মিষ্টি গন্ধ তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

একদিন, হাটে-বাজারে…

সেদিন আবীর তার মায়ের সাথে বাজারে গিয়েছিল। বাজারের কোলাহলের মাঝে এক বৃদ্ধ সাধু হঠাৎ তার সামনে এসে পড়ে।

“নিতে এসেছে, নিতে এসেছে! তোকে ছাড়া কোথাও যাবে না!”

সাধুর চিৎকারে আশেপাশের লোকজন তাকে পাগল বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আবীরের মন কেমন অস্বস্তিতে ভরে ওঠে।

সে বাড়ি ফিরে এসে অনুভব করে, তার শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে বিছানায় পড়ে যায়। ডাক্তার, ওঝা, কেউ তাকে সুস্থ করতে পারে না।

রাত গভীর হলে জানালার বাইরে ছায়ার আভাস দেখা যায়। কেউ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।

সাধুর প্রত্যাবর্তন

আবীরের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেই বৃদ্ধ সাধু আবার আসে। সবাই তাকে ঢুকতে দিতে চায়নি, কিন্তু সে দরজার সামনে বসে মন্ত্র পড়তে থাকে। আচমকা দরজার পাল্লা খুলে যায়।

সাধু ঘরে ঢুকে বলে, “তুমি জানো, কে তোমাকে নিয়ে যেতে চায়?”

আবীর দুর্বল কণ্ঠে ফিসফিস করে, “সায়নী… সে আমার কিছুই করবে না…”

সাধু হেসে ওঠে। “তুমি কি জানো, এই মেয়েটি আসলে কে?”

ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচিত হতে থাকে। বছর দশেক আগে, এক তরুণী আত্মহত্যা করেছিল প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। তার নাম ছিল সায়নী।

তবে সে শুধু আত্মহত্যাই করেনি, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক অভিশপ্ত আত্মায় পরিণত হয়েছিল।

পরিণতি

সাধু কিছু মন্ত্রপাঠ শুরু করে। তখনই এক তীব্র চিৎকার কানে আসে। আবীরের বিছানার পাশে সায়নীর ছায়ামূর্তি ফুটে ওঠে। তার চোখ দুটি অগ্নির মতো জ্বলছে।

“তুমি আমাকে নিতে এসেছিলে?” কাঁপা গলায় জানতে চায় আবীর।

সায়নী ফিসফিস করে বলে, “আমি তোমাকে ভালোবেসেছি… কিন্তু তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও… তবে আমি কিছুতেই ফিরে যাব না!”

সাধু আর এক মুহূর্ত দেরি না করে পবিত্র গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেয়। মুহূর্তেই সায়নীর আর্তনাদে ঘর কেঁপে ওঠে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন কিছু টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে।

সায়নীর ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।

আবীর ধীরে ধীরে উঠে বসে, তার শরীর হালকা মনে হয়।

সেদিনের পর থেকে সে আর কখনো রাতে সেই হাসির শব্দ শোনেনি। কিন্তু জানালার পাশে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে অনুভব করত, কেউ যেন তাকে দেখছে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *