আমরা সকলেই জানি, মা কালির পাশে দুই নারী অবস্থান করছেন। যাকে আমরা ডাকিনী ও যোগিনী নামে চিনি। ভয়ংকর এই দুই নারী আসলে কারা? মা কালির সাথেই বা তাদের কি সম্পর্ক?
আমরা হয়তো অনেকেই ডাকিনী যোগিনীকে ভয় পান। কেউ কেউ আবার তাদের অবদেবতা বলেও অভিহিত করেন। মানুষের রক্ত, মাংস তাদের প্রিয় খাদ্য। তবে আসলে তারা মা কালির শক্তি এবং অশুভ শক্তিকে তারা গ্রাস করে।
চন্ডীমঙ্গলে বলা হয়, খুল্লনার সতীন লখনা তার স্বামীর কাছে নালিশ করছেন, “তোমার মহিনীবালা শিক্ষা করে ডাইন কলা, নিত্য পুজে ডাকিনী দেবতা।”
একথা শোনার পর, তিনি খুল্লনার চুলের মুঠি ধরে শাসন করছেন এবং ঘট ভাঙছেন। অর্থাৎ ডাইন কলা বা ডাকিনীবিদ্যা তখনও নিষিদ্ধ ছিলো। সেই সময় ডাকিনী যোগিনীদের কোন স্থান দেওয়া হতো না।
এরই সাথে ডাইন শিক্ষায় পারদর্শী যারা, তারাই তো ডাইনি। আমরা বহু খবরের কাগজের শিরনামে দেখেছি, ডাইনি অপবাদে দুই আদিবাসী মহিলাকে পিটিয়ে খুন।”
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নিদারুণ গল্প রয়েছে ডাইনি নামে। একদিকে আমাদের ছোটবেলায় ডাইনিবুড়ির গল্প শুনিয়ে যেমন আমাদের দিয়ে বহু কাজ করিয়ে নেওয়া হতো, তেমনই আবার ডাইনি বুড়ির অপবাদে কোন নারীকে হত্যা করা হয়েছে।
অথচ এই ডাইনির সাথে ডাকিনী যোগিনীর আকাশ পাতাল তফাৎ। প্রথমে আমরা জানার চেষ্টা করবো ডাকিনী সম্বন্ধে। কারা এই ডাকিনী?
ডাকিনী শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ডাক থেকে। যার অর্থ জ্ঞান। বৌদ্ধধর্মে, ডাকিনীরা আধ্যাত্মিক সিদ্ধির প্রতীক এবং জ্ঞানের বাহক। তারাই সেখানে জ্ঞানের আধার। যে জ্ঞান লাভের জন্য সাধকরা সাধনা করেন। তাই ডাকিনীরা সাধকের জ্ঞান ও সাধনায় প্রেরণা দেয় এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ দেখায়।
কথিত আছে, চুরাশি মহাসিদ্ধাচার্যের একজন নারপা যখন ধর্মচর্চা করছিলেন, তখন ডাকিনী তাকে আদেশ দিয়েছিলেন। ধর্মচর্চা না করে নারপা যেন ধর্ম অনুশীলনে মন দেন। অর্থাৎ ডাকিনীরা ছিলেন করুণবোদক।
অতীশ দীপঙ্করের সময়েও ডাকিনীদের স্মরণ করা হয়েছে। সর্ববিদ্যা নারীদের ডাকিনী বলে অভিহিত করা হতো। তারাই পরবর্তী কালে পূজিত হতে শুরু করেন।
আমরা ডাকিনীকে যে রাক্ষসী রূপে চিনি, তা কিন্তু আদৌ ঠিক নয়। তিনি হলেন জ্ঞানের ভান্ডার।
এবার আমরা জানবো, ডাকিনী যোগিনীর সাথে মা কালীর কি সম্পর্ক।
সাধারণত, ব্রাম্ভণ্যবাদ ও বৌদ্ধবাদ আলাদা হলেও দুটোই হিন্দু ধর্মের আধার। ইতিহাসে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন রূপে আমরা বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্মের কথা পড়েছি। তা ছিলো খ্রীঃপূর্বের সময়ের কথা। আর আমরা যে কথা বলতে চলেছি, তা হলো হাজার খ্রীষ্টব্দের আশে পাশের সময়ের।
বাংলায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের শাসনকালে এক রকম মতবাদে চলতো। তবে মতবাদ আর আগের মতো নেই। আপনারা হয়তো জানেন, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্ম দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়, হীনযান ও মহাযান।
এই মহাযান আবার বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বঙ্গদেশে এই সময় যে শাখা মুখ্য হয়ে উঠেছিলো তা হলো বজ্রযান, সহজাতপন্থী বৌদ্ধ সাধনা। যার সূত্রপাত খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে। এই ধারার কেন্দ্রে ছিলো তন্ত্র।
এই তন্ত্রের সূত্রেই হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের দেবদেবীরা এক সূত্রে বাধা পড়েছেন।
তারাপীঠের মা তারা যেমন হিন্দুদের দেবী ঠিক তেমনই তারা বৌদ্ধদেরও দেবী। আসলে তন্ত্র হলো ভারতবর্ষের আদিমতর ধর্মাচার। বিভিন্ন সময় নানাভাবে বদলেছে।
আজ তন্ত্র বলতে যা বুঝি, তা কিন্তু হাজার বছরের পুরনো।
এই তন্ত্রসাধনাকে কেন্দ্র করে যে বজ্রযানের সৃষ্টি হলো। সেই শাখায় উঠে আসা ডাকিনী যোগিনীর কথা।
আমরা তো এতক্ষণ ডাকিনীদের কথা জানলাম। এবার জানবো, যোগিনীদের কথা।
যোগিনী শব্দটি এসেছে যোগ থেকে। এই যোগ শব্দের পিছনে রয়েছে বহু ইতিহাস। সিন্ধুসভ্যতার সীলে আমরা এক যোগমুদ্রায় একটি ছবি পেয়েছি। আজও সমগ্র বিশ্ব এই yoga নিয়ে রিসার্চ করছে এবং yoga কেই প্রাধান্য দেয় প্রত্যেকে। এমনকি শ্রীমদ্ভগবত গীতায় শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে এই yoga র কথাই বলেছেন।
গীতা, সিন্দু সভ্যতা ও আজকের দিনে yoga এই তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, এই যোগ বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন রূপে বিরাজ করছে।
এই যোগ থেকেই এসেছে যোগিনী। যারা যোগের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করে। কালক্রমে তারাই হয়ে উঠেছেন দেবীর অংশ শক্তি।
প্রাচীন শক্তি উপাসনায় চৌষট্টি যোগিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে যোগিনীরা দেবীর সাথে শিবেরও সহযোগী। প্রাথমিকভাবে তাদের ভূমিকা ছিলো আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতিকী। তাদের শক্তি সাধনায় সহায়ক হওয়া।
তারা ক্ষেমাঙ্করী, নারায়নী, কালী, ভদ্রকালী, কালরাত্রি, ঝুমাবতী, সর্বমঙ্গলা এরা প্রত্যেকে চৌষট্টী যোগিনীর মধ্যে কয়েকজন। নানা স্থানে এই যোগিনীদের নামে বিভিন্ন মন্দির ও তাদের মূর্তি রয়েছে।
তারা প্রত্যেকে দেবীর সহচরী হিসেবে পুজিত হন।
এবার জানা যাক, ডাকিনী যোগিনীর সাথে কালি সম্পর্কের কথা।
আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন, চৌষট্টী যোগিনীর মধ্যে কালিও রয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, কালি কি করে পার্শচরিত্র হয়ে গেলেন?
আমাদের ভারতে অনন্য দিক রয়েছে। সারা পৃথিবীর ধর্মাচরণের ধারায় একটা সবচেয়ে ব্যতীক্রমী। আমরা মাতৃকাউপাসক জাতি। তারা আজ মাতৃকাউপাসনার ধারা ভারতের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে কেবলমাত্র বাঙালি এবং তথাকথিত প্রান্তিক জনজাতির মধ্যে।
আমাদের ইতিহাস সেই মাতৃতন্ত্রের ইতিহাস। যাকে পুরুষপ্রধান বেদও অস্বীকার করতে পারেনি। তাদের সম্ভব ছিলো না।
ঊষা, নিশা ইত্যাদি বৈদিক শক্তি মাতৃশক্তি। যার ধারাণা সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় ছিলো। আর আজ দেখুন এইগুলো, মা কালি, দেবীদুর্গার সাথে মিলে যায়।
আজ আমরা যেভাবে কালিকে চিনি, এই রূপের পরিচিতি ঘটে পালযুগ থেকে।
আর এখানে সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধ সাধনা ও বজ্রযানের ভূমিকা প্রধান। কারণ তাদের সূত্রেই তন্ত্রচর্চায় নবজোয়ার এসেছিলো।
একটা সময় চৌষট্টি যোগিনীর মধ্যে কিছু দেবী জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তাই চৌষট্টি জনের প্রত্যেকের নাম আমাদের জানা নেই, বা আমাদের কাছে পরিচিতি নেই।
সেইভাবেই উঠে আসে দেবী কালি। কালক্রমে তিনি প্রধান হয়ে ওঠেন। আজকে যে কালিমূর্তিকে আমরা পুজো করি, সেই দক্ষিণা কালির রূপ কল্পনা প্রথম করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সপ্তদশ শতকে। কিন্তু তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দের আগে কি তাহলে কিছুই ছিলো না?
কোনো প্রেরণা ছিলো না?
আসলে এমনটা নয়।
আসলে একসময় মা কালি প্রধান উপাস্য হয়ে উঠলে চৌষট্টি যোগিনী তার অংশশক্তি হিসেবে পরিগণিত হতে থাকেন। ঠিক যেভাবে ডাকিনীরা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ডাকিনী যোগিনীরা এত ভয়ংকর হয়ে উঠলেন কেন?
এই উত্তরে লুকিয়ে আছে তন্ত্রদেব।
তন্ত্র হলো একটি লুক্কায়িত ধর্ম। সাধারণ মানুষের আচার আচরণের উপরেই রূপ নিয়েছে তন্ত্র। সেখানে বৈদিক অনুশাসনের মতো নিয়মরীতি অনুশাসন নেই। ধীরে ধীরে তৈরী হয় বামাচারের ধারা। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য একটাই।
রাগ, কাম, ঘৃণা, অনুরাগ, ঈর্শা, লালসা ইত্যাদিকে জয় করাকেই বিজয় সাধকের সিদ্ধি। কিন্তু সেই সিদ্ধিতে সাধক এক একটি পথ বেছে নিয়েছেন।
বামাচারীদের মধ্যে দেহ সাধনা, শব সাধনা, মদ মাংস ইত্যাদি নানা উপাচার উঠে এসেছে। হারের মালা, মাথার খুলি এসব নিয়ে সাধকরা সাধনা করেছেন। তাই তাদের উপাস্য দেবী বা শক্তিরাও কেউ শবের উপর অনুষ্ঠান করেছেন, কেউ মৃত মুর্তির উপরে, তাদের গলায় উঠে এসেছে করটির মালা। উঠে এসেছে অগ্নিকা মূর্তি। করাল বদনা কালির মতো। তার পাশে ডাকিনী যোগিনীরাও ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছেন। এরপর ক্রমে ক্রমে আমাদের ধারণা হয়েছে যে তারা ভূত প্রেত। তারা অপদেবতা।
আমরা ডাইনিকে ভয় পেয়েছি, পুরিয়ে বা পিটিয়ে মেরেছি। এরজন্য একটা শ্রেণীর মানুষও দায়ি। যারা তাদের সাধনাকে দাঁড় করিয়েছেন মানুষের বিরূদ্ধে।
বলা বাহুল্য, আমরা সাধারণত দেখতে পাই, ট্রেনে বাসে, দেওয়ালে, নানা স্থানে থাকে না পোস্টার, যেখানে বড়ো বড়ো হেডলাইনে লেখা থাকে তান্ত্রিকদের নাম এবং বলা হয়, দু মিনিটে বশীকরণ, সমূলে শত্রুনাশ ইত্যাদি।
সত্যিই যদি তন্ত্রসাধনায় এমনটা হতো, তাহলে রাশিয়া, ইউক্রেন বা ইজরায়েল প্যালেস্তাইনকে অনায়াসেই বশীকরণ করা যেতো, অনায়াসেই শত্রুনাশ করা যেতো।
এই সমস্ত মানুষেরাই তন্ত্রসাধনাকে কলুসিত করেছেন। মানুষের কাছে ভয়ের করে তুলেছেন।
তবে যাই হোক, তন্ত্রসাধনার সত্যতা নিয়ে আমরা আলাদা করে একটি ভিডিও নিয়ে আসবো। যদি আপনারা দেখতে চান। কারণ, তন্ত্র সাধনায় ভালো মন্দ উভয়ই ফল লাভ হয়। ফল লাভ হয় যোগীর সাধনার উপর।
তবে যাই হোক, ডাকিনী যোগিনীরা কোনো ভয়ংকর অপদেবতা নন। তারা আসলেই দেবী। যাদের আমরা পুজো করি।
এবার আপনি বলুন, আপনিও কি ভাবতেন ডাকিনী যোগিনীরা অপদেবতা? কমেন্ট বক্সে অবশ্যই লিখে জানাবেন।