সন্ধ্যার আবছা আলোয় পার্কের নির্জন কোণায় বসেছিল রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা। চারপাশে গাছের পাতাগুলো অলসভাবে দুলছিল হালকা বাতাসের ছোঁয়ায়। প্রিয়াঙ্কার কালো শাড়ির কাঁধের আঁচল একটু পিছলে পড়েছে, তার দীর্ঘ চুলগুলো উড়ে এসে রাহুলের গালে নরম ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। রাহুল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
“তুমি জানো, এই জায়গাটায় কিছু একটা রহস্য আছে,” রাহুল ফিসফিস করে বলল।
প্রিয়াঙ্কা হেসে বলল, “তুমি বেশি সিনেমা দেখো!”
ঠিক তখনই ঝোপের আড়াল থেকে একটা চাপা শব্দ এলো। প্রিয়াঙ্কা সজাগ হয়ে উঠল, রাহুল তার কোমর জড়িয়ে ধরল এক অনুচ্চারিত আশ্বাসের ছোঁয়ায়। হঠাৎ, অন্ধকারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো এক ছায়ামূর্তি। মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে, চোখের দৃষ্টি কেবল জ্বলজ্বল করছে।
“তোমরা এখানে কী করছো?” গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
রাহুল এক ধাপ সামনে এগিয়ে বলল, “আমরা এখানে বসেছিলাম। তুমি কে?”
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এখান থেকে চলে যাও। এই জায়গাটা নিরাপদ নয়।”
প্রিয়াঙ্কা রাহুলের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। রাহুল বলল, “তুমি আমাদের সতর্ক করছো কেন?”
লোকটি পকেট থেকে একটা পুরনো কাগজ বের করে রাহুলের হাতে দিল। “পাঁচ বছর আগে এখানেই এক মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল,” সে বলল, “তার পরনে ছিল কালো শাড়ি, কালো মোজা, আর নীল ফিতা বাঁধা জুতো…”
লোকটি মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
প্রিয়াঙ্কার ঠোঁট হালকা কাঁপছিল। রাহুল তার মুখ স্পর্শ করল, তার চোখের গভীরে তাকিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমি আছি।”
প্রিয়াঙ্কা ধীরে ধীরে রাহুলের বুকের কাছে এল, তার শরীরের উষ্ণতা একাকার হতে লাগল রাতের শীতল বাতাসের বিপরীতে। রাহুলের হাত আলতোভাবে নামল তার কোমরে, আঙুলগুলো হালকা স্পর্শে শিহরণ তুলল।
বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তাদের উষ্ণ শ্বাস, ঠোঁটের মধ্যে দূরত্ব কমতে লাগল, সময় যেন স্থির হয়ে গেল। দূর থেকে রাতের পাখিদের শব্দ তাদের গোপন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকল। মূহুর্তের মধ্যে কামুক উত্তেজনার প্রকাশিত হলো তাদের অজান্তে। ভালোবাসার জোয়াড় যেন উথলে উঠেছে তাদের হৃদয়ে শরীরে। শিহরণ জাগলো রাহুলের আলতো স্পর্শে।
ঠিক তখনই, দূরের ঝোপ থেকে একটা চাপা হাসির আওয়াজ এলো। কেউ যেন নিঃশব্দে দেখছে, গাছের ছায়ায় লুকিয়ে।
রাহুল মুহূর্তে থেমে গেল, তার চোখ অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল।
একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল, যেন কারও নিশ্বাস তাদের গায়ে লাগল। হঠাৎ, ঝোপের আড়ালে কেউ ফিসফিস করে বলে উঠল, “তোমরা কি আমার জায়গায় এসেছো…?”
প্রিয়াঙ্কা আতঙ্কে রাহুলকে আঁকড়ে ধরল। রাহুল চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু কিছু একটা যেন চলাফেরা করছে, গাছের ছায়ায় অস্বাভাবিক নড়াচড়া।
এক মুহূর্তের মধ্যে চারপাশটা বদলে গেল। তারা যেন আর পার্কে নেই, তারা চলে গেছে অন্য এক জগতে। সামনে এক মায়াবী আলো, আর সেখানে এক বিভৎস দৃশ্য। এক যুবতী মেয়েকে মাটিতে ফেলে একজন পুরুষ নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় নিপীড়ন করছে। মেয়েটির গায়ে সেই একই পোশাক—কালো শাড়ি, কালো মোজা, আর নীল ফিতা বাঁধা জুতো।
মেয়েটি করুণ আর্তনাদ করতে লাগলো, “প্লিজ ছেড়ে দাও! আমি তো তোমার বোনের মতো! কিন্তু ওই পুরুষের সেদিকে কোনো গুরুত্বই নেই। পুরুষটি কেবল শরীর দখলের প্রচেষ্টায় রত! উদ্ধাংশ থেকে সড়িয়ে দিলো আঁচোল। এক নিমেষে ছিঁড়ে দিলো বক্ষের উপরিভাগ। মেয়েটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, সজড়ে দিলো গালে একটি থাপ্পর। যার দরুণ মেয়েটি জ্ঞান হারালো এক নিমেষে! মেয়েটিকে বিবস্ত্র করে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করতে লাগলো পুরুষটি।
যা দেখে রাহুলের শরীর ঘামতে লাগল। সে সামনে এগিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন অবশ হয়ে গেল।
তখনই প্রিয়াঙ্কা ধীরে ধীরে তার দিকে ঘুরে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টি বদলে গেছে। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি।
“তুমি কি মনে করতে পারছো?” তার কণ্ঠস্বর হিমশীতল।
রাহুলের মনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে লাগল সেই অতীতের কথা— সেই এক শীতল সন্ধ্যেবেলার কথা। একটি মেয়ে স্কুল থেকে পড়তে গিয়েছিলো টিউশন ব্যাচে। পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরতে দেরী হয় তার। রাহুলের নজর ওই মেয়েটির দিকে বহুদিন ধরেই ছিলো। সে কেবলই মেয়েটির কথা কল্পনা করতো এবং কামুক বাসনায় নিজেকে লিপ্ত করতো কখনো বিছানায় কখনো বা বার্থরুমে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় রাস্তা ছিলো জনশূন্য, শীতল পরিবেশের কারণে রাস্তায় তেমন কোনো লোক ছিলো না। মেয়েটি ছিলো রাহুলের থেকে জুনিয়ার। স্কুল আলাদা হলেও টিউশন ব্যাচের ঠিকানা ছিলো একই। সেই সূত্রেই পরিচয় হয়েছিলো রাহুল ও তানিয়ার। তবে তাদের মধ্যে সেই রকম ঘনিষ্টতা না থাকলেও, দাদার মতোই শ্রদ্ধা করতো তাকে।
কিন্তু সেদিন রাতে, রাহুলকে দেখতে পেয়ে, তানিয়ার মনে যেন একটু সাহস এসেছিলো, জনশূন্যহীন রাস্তায় পরিচিত কাউকে দেখলে যে কোনো মেয়েরই মনে সাহস আসে, তাও আবার দাদা বলে যাকে সম্বোধন করে।
কিন্তু রাহুল বোধ হয় দাদা’র মতো পরিচয় দিতে পারেনি। বিভিন্ন রকম কথপথনের জালে তানিয়াকে নিয়ে আসে ওই পার্কের পিছনের দিকে, যেখানে সন্ধ্যের পর, কাকপক্ষীও খবর নেয় না। পার্কের পিছন দিকে থাকা জঙ্গলের কাছে আসতেই রাহুল তার নিজের পাশবিক রূপ দেখিয়ে দেয়। প্রথমে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তানিয়াকে। তারপরেই শুরু হয় তার উপর নির্মম অত্যাচার ও বলাৎকার।
সমস্ত ঘটনাই যেন রাহুলের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ঘটতে লাগলো।
যখন তার জ্ঞান ফিরলো, বিবস্ত্র হয়ে পড়া থাকা মেয়েটির চোখে যে করুণ আর্তনাদ ছিলো, তার পরিবর্তন ঘটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো এবং ভয়ংকর চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সে-ই তো সেই নিপীড়ক! এই মেয়েটি – তানিয়া। ধীরে ধীরে রূপ পরিবর্তন হয়ে যে নারীর আকার নেয়, তা আর কেউ নয়, সে আসলে প্রিয়াঙ্কা!
যা দেখে রাহুলের গলা শুকিয়ে এল, হাত-পা অবশ হয়ে গেল। “তুমি…?”
হঠাৎ সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। হঠাৎ পাশে চোখ যেতেই দেখে, তার পাশেই বসে রয়েছে প্রিয়াংকা।
প্রিয়াঙ্কার চোখে বিদ্রুপের ছায়া। “তুমি কি জানো, সকালে আমার বিবস্ত্র শরীর দেখার জন্য কত লোক এসেছিলো! প্রত্যেকের মধ্যেই আমার জন্য ছিলো শোক, তবে তা ছিলো বাহ্যিক। আসলে তো ওরা দেখতে এসেছিলো আমার নগ্নতা দেখতে।
কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে এবং আমার মৃত শরীর নিয়ে চলে যায় পোস্টমর্টামে। সেখানে কিন্তু আমার বাবা এলো না। কারণ, বাবা আমার জানতোই না, যে আমি পরলোকগমন করেছি। তাই বাবার তখনও আশা ছিলো, মেয়ে আসবে!
কিন্তু সকালেও যখন আমি বাড়ি ফিরলাম না, তখন বাবার মধ্যে তৈরী হলো উদ্বিগ্নতা। পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে হাজির হলো থানায়। থানা থেকেই বাবা জানতে পারে, আমাকে ধর্ষষ করে হত্যা করা হয়েছে। বিচারের আশায় বাবা দিন গুনলো, কিন্তু কিছুই হলো না। মাস যেতে না যেতেই ফাইল ক্লোজ হয়ে গেলো। ঘটনার শুরুর দিকে আমার বিচার নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলো বেশ ক’জন। কিন্তু মাস যেতে না যেতেই সবাই সবকিছু ভুলে গেলো।
আমার বাবা প্রশাসনের কাছে বহু কেঁদেছিল? বিচার চেয়েছিল? শেষ পর্যন্ত বাবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। কারণ, আমি ছাড়া বাবার আর কেউ ছিলো না। মা তো কোন ছোটবেলায় চলে গিয়েছিলো আমাদের ছেড়ে। তাই বাবা আমাকে খুব যত্ন করে মানুষ করেছিলো। আর সেই বাবাই আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে!”
এই বলেই, তার মুখে এক ভয়ংকর হাসি ছড়িয়ে পড়তে থাকে আকাশে বাতাসে!
“ যখন তুমি মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছিলে… আর আমি? আমি অপেক্ষা করছিলাম, প্রতিশোধের জন্য। পার্কে বসে যে বৃদ্ধকে দেখলে, সে আসলে আমার বাবা!
তোমার বাসনা দেখছি আজও যায়নি! বাবা যখন বললো, এখানে একটা মেয়ে এসেছিলো পাঁচ বছর আগে! এটা শুনেও তোমার কোন ভয় হলো না, কোন অনুভূতি কাজ করলো না।
তুমি কখনো ভাবলেই না যে, পার্ক ছাড়া আমি আর কোথাও তোমার সাথে দেখা করি না কেন? কেন একই ড্রেসে তোমাকে দেখা দিই? কেন তোমাকে ফোন নম্বর দিইনি। মাস ছয়েকের রিলেশন থাকা সত্ত্বেও?
আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছিলাম, বিশ্বাস ভাঙলে কি রকম কষ্ট হয়? আজ আমি তোর বিশ্বাস ভাঙবো, সাথে তোর আত্মাকে মুক্ত করবো! এরসাথে আমি আর বাবাও মুক্ত পাবো। অনেকদিন ধরে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছি। আজ সবকিছু শেষ হবে!”
আবারও এক ভয়ংকর হাসির শব্দ ভেসে উঠলো, আকাশে বাতাসে। প্রকৃতিও যেন সমর্থন করছে, প্রিয়াংকার প্রতিশোধ পূণ্য করার জন্য।
বাতাসে হঠাৎ হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তি ঘনিয়ে এলো চারপাশে। রাহুল চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। অন্ধকারের মধ্যে একজোড়া হাড়ের মতো হাত তার গলায় শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরল।
চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।
পরেরদিন সকালে পার্কের কেয়ারটেকার ঝোপের পাশে পড়ে থাকা একটা কালো শাড়ির টুকরো আর নীল ফিতা বাঁধা একজোড়া জুতো পেলো। কিন্তু আশেপাশে কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
শুধু বাতাসের মধ্যে তখনও ফিসফিস শব্দ ভাসতে লাগলো—
“প্রতিশোধ শেষ হয়েছে… তবে শাস্তি নয়!…”