নিঃশব্দ রাত। জানালার ওপারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূর থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা পাখির করুণ সুর। ঘরের কোণে আবীর বসে আছে নির্বাক। তার চোখে ধরা পড়েছে অতীতের এক বিভীষিকা—একটা ছায়া, একটা আর্তনাদ, একটা ন্যায়বিচারের কান্না।
প্রথম পরিচয়
পূজা আর আবীর একই ক্লাসে পড়ত। স্কুলের সেই নির্দোষ ভালোবাসা কবে যে গভীর সম্পর্কের দিকে গড়াল, তা তারা নিজেরাও জানত না। পূজা আবীরকে একসময় প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। আবীরও ভালোবাসত, তবে তার ভালোবাসা ছিল স্বার্থপর। পূজা স্বপ্ন দেখেছিল একসঙ্গে থাকার, একসঙ্গে সংসার করার। কিন্তু আবীর? সে শুধু পূজার শরীরটাকে ভালোবেসেছিল, তার হৃদয়কে নয়।
প্রথমদিকে পূজাও বুঝতে পারেনি। সে ভেবেছিল, আবীরের মনের গভীরে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার অগ্নিশিখা, যা সময়ের সাথে জ্বলে উঠবে। কিন্তু সময়ই তাকে বুঝিয়ে দিল, সে কত বড় ভুল করেছিল!
ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পূজা আবীরকে বলেছিল, ‘‘আমাদের সম্পর্কটা একটা নাম দাও, না হলে আমি এই পথ থেকে সরে যাব।’’
আবীর তখন হেসেছিল। বলেছিল, ‘‘কেন এত তাড়া? সময় নাও।’’
পূজা বুঝতে পারেনি, সময় নেওয়ার নাম করে আবীর আসলে সম্পর্কটাকে ধোঁয়াশার মধ্যে রাখছে। পূজা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আবীর শুধু আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিল, বাস্তবে কোনো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়নি।
তারপর হঠাৎ একদিন পূজা জানতে পারল, আবীর বিয়ে করছে! কিন্তু তাকে নয়, অন্য এক মেয়েকে—প্রিয়াঙ্কাকে। খবরটা শুনেই পূজার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে সে পাগলের মতো হয়ে গেল।
কিন্তু আবীর? সে একবারও ফিরে তাকাল না। বরং তার বিয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সে ভুলে গেল পূজাকে, ভুলে গেল তার ভালোবাসা, ভুলে গেল তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি। পূজা চিৎকার করে কাঁদলেও, তার কান্না পৌঁছায়নি আবীরের হৃদয়ে।
সময়ের আবর্তন
বছর পেরিয়ে গেল। আবীর আর প্রিয়াঙ্কার সুখের সংসার হলো। তাদের ঘর আলো করে এল একটি কন্যাসন্তান—আয়েশা।
আয়েশা ধীরে ধীরে বড় হলো। সে বাবার চোখের মণি ছিল, মায়ের আদরের ধন। আবীর তার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস যে কী নির্মম হতে পারে, তা সে তখনও জানত না।
একদিন এক ঝড়ের রাতে খবর এলো—আয়েশা আত্মহত্যা করেছে। সে তার ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। আবীর হতবাক হয়ে গেল। কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার এত ভালোবাসার মেয়ে, যে তার জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান, সে কীভাবে এমন করতে পারে!
নিঃসঙ্গতার শাস্তি
আত্মহত্যার কারণ জানার পর আবীরের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল। আয়েশা প্রেমে প্রতারিত হয়েছিল। তার প্রেমিক তাকে ঠকিয়েছিল, তাকে শুধু ব্যবহার করেছিল, তাকে ভালোবাসার নামে একরকম খেলনা বানিয়েছিল। অবশেষে হৃদয় ভেঙে সে জীবন থেকে মুক্তি নিল।
আবীর সেই মুহূর্তে যেন অতীতে ফিরে গেল। তার সামনে ভেসে উঠল পূজার কান্নার মুখ, তার ভাঙা স্বপ্ন, তার আর্তনাদ। পূজা তো সেদিন তাকে বলেছিল, ‘‘আমি যদি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে না পারি, তবে কি আমিও একদিন এভাবে শেষ হয়ে যাব?’’
আজ যেন আয়েশার মৃত্যু সেই প্রশ্নের জবাব দিল।
আবীর তখন বুঝল, সময় ঠিক এইভাবেই প্রতিশোধ নেয়। পূজার কান্না, তার ভোগান্তি, তার হারানোর যন্ত্রণা—সেই সবকিছু সময় ফিরিয়ে দিয়েছে। এবার আবীরের পালা।
শেষ প্রার্থনা
আবীর এখন একা। প্রিয়াঙ্কা তার সাথে কথা বলে না। আয়েশার মৃত্যুর পর তাদের সংসার আর আগের মতো নেই। তাদের মাঝে পড়ে গেছে এক গভীর শূন্যতা, এক শীতল দেয়াল।
আবীর প্রতিদিন রাতে পূজার মুখটা মনে করে। যদি পূজা আজ বেঁচে থাকত, তাহলে কি সে ক্ষমা করত? না কি সে বলত, ‘‘এই তো সময়ের বিচার!’’
একদিন আবীর পূজার বাড়িতে গেল। পূজার মা দরজা খুললেন। তার চোখেমুখে শোকের ছাপ। পূজার কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘‘পূজা তো সেই অনেকদিন আগেই চলে গেছে। তোমার বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারেনি। একদিন নদীর ধারে তার নিথর দেহ পাওয়া গিয়েছিল।’’
আবীর সেদিন প্রথমবার কাঁদল। অনেক বছর পর তার চোখে জল এল। সে বুঝল, তার শাস্তি অনেক আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। সময় শুধু অপেক্ষা করেছিল, কখন তাকে সেই শাস্তি দেওয়া হবে।
সমাপ্তি
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আবীর যেন দেখল, পূজা দাঁড়িয়ে আছে এক চাঁদনী রাতের আলোয়। তার ঠোঁটে এক করুণ হাসি, চোখে দুঃখের ছায়া। আবীর ফিসফিস করে বলল, ‘‘ক্ষমা করো পূজা। আমি দোষী।’’
কিন্তু পূজা কিছু বলল না। সে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল রাতের নিঃসঙ্গতার মাঝে।
সময় নীরব, কিন্তু তার বিচার কখনোই মিথ্যা হয় না।